বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম
“নিঃসন্দেহে তাঁরা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত, তাঁরা আশা ও ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তাঁরা আমার কাছে বিনয়ী ছিলো।” [সূরা আম্বিয়া, ২১:৯০]
কারাগারে থাকার পর থেকে আমি অনেকগুলো চিঠি পেয়েছি। এ চিঠিগুলোর মূলভাবও খুব কাছাকাছি আর তা হলো দু’আ ব্যতীত অন্য কিছু করতে না পারার অক্ষমতা। “আমার খুব অসহায়, দু’আ ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই” বা “আমাদের কিছু করার নেই, তাই আমারা তোমাদের জন্য শুধু দু’আই করছি” – প্রায়ই এরকম অনেক কথা আমরা শুনতে পাই। এসকল কথাবার্তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে আমি কিছু অসারতা খুঁজে পেয়েছি।
শুরুতেই বলে নেই দু’আ অন্যতম একটি ইবাদাত যা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। একজন মুসলিম অপর মুসলিম ভাইকে দিতে পারে এমন সর্বোত্তম উপহার হচ্ছে দু’আ। দু’আ হচ্ছে মু’মিনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এটি দিয়ে মু’মিন সকল জুলুমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। তবে আমরা কুরআন এবং হাদীসে বাহ্যিক প্রচেষ্টা ছাড়া শুধু দু’আর উপস্থিতি খুব কমই দেখতে পাই। বরং কুরআন, হাদীস, রাসূল ﷺ এর জীবন, সাহাবাদের (রাঃ) জীবন বা সালাফদের জীবনে আমরা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দু’আকে বাহ্যিক কাজের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় দেখতে পাই। তাঁরা সকলেই লক্ষ অর্জনের জন্য দু’আ করেছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, উহুদের যুদ্ধে রাসূল ﷺ এবং মুসলিমরা মদীনায় বসে থেকে দু’আ করেননি বরং তারা শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য উহুদের ময়দানে জড় হয়েছেন। এরপর যুদ্ধের শুরুতে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং যুদ্ধের শেষে প্রতিটা সময় দু’আ করেছেন। মদীনাতে কর্তৃত্ব অর্জন করার পর রাসূল ﷺ ইসলামকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শুধু বসে বসে দু’আ করেননি বরং তিনি বিভিন্ন প্রচারক, আলিম ও দা’ঈ কে ইসলামের দিকে ডাকার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেছেন এবং সকল চেষ্টার শুরুতে এবং শেষে তিনি দু’আ করেছেন। কুরআন এবং হাদীসে এরকম আরও অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।
উপরে বর্ণিত আয়াতে আল্লাহ্ চেষ্টার সাথে দু’আকে উল্লেখ করেছেন। তিনি চেষ্টা ছাড়া শুধুমাত্র দু’আকে উল্লেখ করেননি। প্রচেষ্টা ছাড়া দু’আকে তখনই উপস্থাপন করা হয়েছে যখন অন্য সকল প্রচেষ্টার পথই বন্ধ থাকে।
ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝার জন্য ইউনুস (আঃ) কে উদাহরণ হিসেবে চিন্তা করা যায়। ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র দু’আই করেছেন কারণ তখন তাঁর পক্ষে দু’আ ছাড়া অন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। মূসা (আঃ) যখন ফিরআউন ও সমুদ্রের মাঝখানে আটকা পড়েছিলেন তখন তিনি শুধুমাত্র দু’আই করেছেন কারণ উনি ইতোমধ্যে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন আর তখন অন্য কোনো কিছু করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এমনিভাবে রাসূল ﷺ তায়েফের লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে উপহাস, বিদ্রূপ এবং তাদের মারধর সহ্য করেছেন। যখন রক্ত রাসূল ﷺ এর জুতার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করল তখনই তিনি দু’আ করা শুরু করেন। পাহাড়ের গুহায় আটকে থাকা তিন ব্যক্তির গল্পেও আমরা দেখি যে, প্রত্যেকে শুধু দু’আই করেছেন করণ তাদের পক্ষে এই বিশাল পাথরকে সরানোর জন্য অন্য কোনো কাজ করা সম্ভব ছিল না।
তাই, আমরা যদি আমাদের জীবনের দিকে লক্ষ করি তাহলে আমরা আমাদের দু’আ এবং প্রচেষ্টার মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাব। জীবিকা অর্জনের জন্য আমরা কেউই শুদুমাত্র ঘরে বসে দু’আ করি না। পোশাক বা সম্পদ কেনার জন্যও করি না। আমাদের ঘরবাড়ি সাজানোর জন্যও আমারা শুধুমাত্র দু’আ করি না। এসকল ক্ষেত্রেই আমরা দু’আর সাথে চেষ্টাও করি। কিন্তু যখনই অপর মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য বা মুসলিম বন্দিদের জন্য সাহায্যের বিষয়গুলো আসে তখন আমার আমাদের ভোল পাল্টাই। আমরা কোনো চেষ্টা না করে শুধুমাত্র দু’আই করে যাই। আমাদের এ কাজকে সমর্থন করার জন্য হাস্যকর যুক্তি দেখাই।
আমার এ বন্দিজীবন ২০০৪ সালের অগাস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে। তখন থেকেই আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই আমাকে মুক্ত করার জন্য দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমার মুক্তির জন্য কখনও প্রচারণা চালাচ্ছেন কখনও টেলিফোনে কথা বলছেন, কখনও মিটিং করছেন, কখনও লেখালেখি করছেন, কখনও সরাসরি কথাবার্তা বলছেন, কখনও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করছেন। আল্লাহ্ তাঁদের সকলকেই উত্তম প্রতিদান দান করুক। তারা আমার জন্য অনেক অনেক দু’আ করছেন- আল্লাহ্ তাঁদের দু’আ কবুল করুক। এমনকি ঠাণ্ডা ও বৃষ্টির মধ্যে একটি প্রতিবাদ সভায় পিতামাতাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য শিশুরাও তাদের আরামকে ত্যাগ করে তাদের ভূমিকা পালন করেছে। আমার বৃদ্ধা বাবা (আল্লাহ্ উনাকে রক্ষা করুক) একটি প্রতিবাদ সভায় নাগরিকদের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র আমার বাবা, আমার পরিবার, আমার আত্মীয় স্বজন বা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাই কেনো এসকল প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করছে? তারা কেনো শুধুমাত্র ঘরে বসে দু’আ করছে না? কারণ এখন তাদের পরিবারের একজন কারাগারে বন্দি। গুয়েস্তানামো বে এর কোনো চাইনিজ লোক কারাগারে বন্দি নয়। তাই তারা শুধুমাত্র দু’আ করে ঘরে বসে থাকেনি। তারা বিভিন্ন প্রতিবাদ, প্রচারণার মাধ্যমে আমাকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে।
এখন আমরা আমাদের এ ক্ষণস্থায়ী জীবন উপভোগ করছি। ব্যাংকে জমানো টাকা, ছেলে মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, স্থায়ী চাকুরী, সুন্দর বাড়ি আর সুখী পরিবার নিয়ে আমাদের জীবন কেটে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে মুসলিম কারাবন্দীদের জন্য শুধুমাত্র দু’আ করে আমরা দায়িত্ব পালনের আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি। কিন্তু কী হবে যদি সামনের দিন আমাকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়? কী হবে যদি আমার ঘরের দরজা ভেঙ্গে আমার স্বামী, ভাই, সন্তান বা বাবাকে অস্ত্রধারী শয়তানরা পাশবিক নির্যাতন করে তারপর তাকে কারাগারে বন্দি করে, ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষের জন্য তাকে চার দেয়ালের মাঝে আমরণ আটকে রাখে? তখন কি পরিস্থিতি পালটে যাবে না? তখনও কি আমরা অসহায় থাকব যেমনটি আমরা থেকেছিলাম গুয়েস্তানামো বে এর চাইনিজ লোকটির জন্য? তখন কি আমরা শুধুমাত্র দু’আ করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ করব? নাকি আমরা পুরো পরিবার তার মুক্তির জন্য চেষ্টা করব? আমরা কি তার জন্য টেলিফোনে কথা বলা, লেখালেখি, বিভিন্ন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ, প্রতিবাদ সভা প্রভৃতি করব না? নিজের সাথে সৎ হলে আমরা দেখতে পাব যে, আমাদের মৃত আত্মা এবার জেগে উঠবে। আমরা এবার শুধু ঘরে বসে দু’আ করব না এর সাথে চেষ্টাও করব।
তাই, সামনে থেকে যখনই দু’আর মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব সেরে ফেলার চেষ্টা করবেন তখন নিজেকে সৎভাবে প্রশ্ন করবেন আপনার পরিস্থিতি কি আসলেই মাছের পেটের ইউনুস (আঃ) এর মতো অথবা সমুদ্রের সামনের মূসা (আঃ) এর মতো? যদি কারও শুদুমাত্র দু’আ ছাড়া অন্য কিছু করার না থাকে তারা হচ্ছে আমাদের মতো কারাবন্দিরা। কিন্তু এমনকি আমরা জেলে থেকেও দু’আর বাইরেও অনেক কিছু করি। আমাদের মধ্যে যারা লেখালেখি করতে পারি তারা লেখালেখি করি। যারা ছবি আঁকতে পারি তারা ছবি আঁকি। এমনকি যদি আমরা লিখতে বা ছবি আঁকতে নাও পারি তারপরও জেলের অন্যান্য কয়েদিদের মাঝে মুসলিমদের প্রতি ভালো ধারণা জন্মানোর চেষ্টা করি। এতে তারা জেল থেকে বের হলে মুসলিম এবং মুসলিম বন্দিদের প্রতি সুধারণা পোষণ করবে। তারা মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার আগে কয়েকবার চিন্তাভাবনা করবে।
কাজ এবং দু’আ একে অপরের পরিপূরক। তাই যখনই আমরা কোনো আলোচনা সভা আয়োজন করার পরিকল্পনা করি তখন এর পূর্বে দু’আ করি যাতে ভালোভাবে আমরা পরিকল্পনা করতে পারি। সভা চলাকালীন সময়েও দু’আ করি, সভা শেষেও দু’আ করি যাতে আমাদের প্রচেষ্টা ইসলামের জন্য উপকারী হয় এবং যাতে আল্লাহ্ আমাদের এ প্রচেষ্টা কবুল করে নেন। এটাই হচ্ছে কষ্টকর উপরিস্থিতে দু’আর ভূমিকা। তাই পরবর্তিতে যখন শয়তান আমাদেরকে ‘আমি শুধুমাত্র দু’আই করতে পারি অন্য কিছু না” এ ধরনের কথা বলে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করবে তখন আমরা নিজেদেরকে সৎভাবে প্রশ্ন করব এবং আমরা দেখতে পাব এসকল কথা দায়িত্ব থেকে দায়সারাভাবে মুক্তিলাভের একটা অগ্রহণযোগ্য অজুহাত ছাড়া আর কিছুই না।