আমাদের এলাকায় মৃতের রূহের মাগফিরাত কামনার উদ্দেশ্যে তিন, সাত, একুশ ও চল্লিশ ইত্যাদি তারিখে কুরআন খতম, মিলাদ ও দুআর অনুষ্ঠান করা হয় এবং জাঁক-জমকের সাথে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে বোঝা যায় না যে, রূহের মাগফিরাত না, বিবাহর অনুষ্ঠান। এ ধরনের অনুষ্ঠানে আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামবাসী ও এলাকার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, যেমন চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাতবর, পার্টির নেতাসহ সবাইকে দাওয়াত করা হয়। এমনকি অনুষ্ঠানের দিন-ক্ষণ পর্যন্ত দৈনিক পত্রিকায় ঘোষণা করা হয়। যা আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় তামদারী, মজলিস, বেপার, ফয়তা, মিদুনী ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। যে এলাকাতে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, উদ্দেশ্যে অভিন্ন।
একশ্রেণীর আলেম এ ধরনের অনুষ্ঠান যথারীতি করে যাচ্ছেন। আরেক শ্রেণীর আলেম এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। ভালো মন্দ কিছুই বলেন না। আরেক শ্রেণীর আলেম এই অনুষ্ঠানগুলোকে বিদআত ও নাজায়েয বলে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। কোনটা সহীহ আর কোনটা ভুল তা পার্থক্য করতে পারছে না। এখন প্রশ্ন এই যে, এই পদ্ধতি শরীয়তসম্মত কি না। সহীহ পদ্ধতি কোনটা তা জানালে আমরা বিভ্রান্তির বেড়াজাল হতে বের হয়ে সেভাবে আমল করার জন্য সচেষ্ট থাকব।
মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের জন্য দুআ করা এবং বিভিন্ন নফল ইবাদত যেমন-দান-সদকা, তাসবীহ-তাহলীল, তেলাওয়াত ইত্যাদি করে তার সওয়াব মৃতকে পৌঁছানো গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল, যা হাদীস শরীফের বহু দলীল দ্বারা প্রমাণিত। তবে এটি একটি ব্যক্তিগত আমল। কোনো দিন-তারিখ ও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই যখন ইচ্ছা তখনই এ আমল করা যায়।
কিন্তু বর্তমানে এই সহজ আমলটিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দান করে অনেক ক্ষেত্রেই তাকে সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহের কাজে রূপান্তর করা হয়ে থাকে। যেমন-
১. তিন দিনা, সাত দিনা,একইশা, চল্লিশা এ সকল নামে এ অনুষ্ঠান যথাক্রমে মৃত্যুর ৩য়, ৭ম, ২১ শ ও ৪০ তম তারিখে করাকে জরুরি মনে করা হয় বা কমপক্ষে এরূপ ধারণা রাখা হয় যে, এ তারিখগুলোর বিশেষত্ব রয়েছে। অথচ শরয়ী দলীল-প্রমাণ ছাড়া বিশেষ দিন-তারিখ নির্ধারণ করে নেওয়া বিদআত ও নাজায়েয।
২. ঈসালে সাওয়াবের প্রচলিত পন্থায় আরেকটি বড় আপত্তিকর দিক হল এতে যিয়াফত তথা আড়ম্বরপূর্ণ দাওয়াত অনুষ্ঠানকেই ঈসালে সওয়াবের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। অথচ শরীয়র্তে যিয়াফতের আয়োজনের কথা তো আছে আনন্দের মুহূতে, মুসিবতের মুহূর্তে নয়। হাদীস শরীফে এসেছে-হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ আলবাজালী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (তরজমা) ‘আমরা (সাহাবাগণ) দাফনের পর মৃতকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়া ও খাবারের আয়োজন করাকে ‘নিয়াহা’ বলে গণ্য করতাম।’ (মুসনাদে আহমদ ২/২০৪; ইবনে মাজাহ ১৬১২)
কোনো দিন-তারিখ নির্ধারিত না করে গরীব-মিসকীনদেরকে খানা খাওয়ানোটাও ঈসালে সাওয়াবের একটি বৈধ পন্থা। কিন্তু এমন যিয়াফতের আয়োজন করা যাতে অনেক ক্ষেত্রে সমাজের নেতৃত্বস্থানীয় ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এটি আদৌ ঈসালে সাওয়াবের গ্রহণযোগ্য পন্থা নয়।
৩. হাফেযদের দ্বারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুরআন খতম করা হয়। অথচ এক্ষেত্রে কুরআন পড়ার বিনিময় দেওয়া-নেওয়া নাজায়েয।
৪. অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যয়ভার নির্বাহ করা হয় মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া এজমালী সম্পদ থেকে, ওয়ারিশদের মাঝে কোনো নাবালেগ থাকলেও তার সম্পদ বাদ দেওয়া হয় না। অথচ নাবালেগের সম্পদ তার অনুমতি নিয়েও খরচ করা নাজায়েয। এমনিভাবে বালেগ ওয়ারিশদের ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ রাখা হয় না যে, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি আছে কি না।
৫. এ ধরনের অনুষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই লোক দেখানোর জন্য বা সামাজিক রেওয়াজে প্রভাবিত হয়ে করা হয়। এটাও নাজায়েয। শরীয়ত বিরোধী এ জাতীয় আরো কর্মকান্ড এসব অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে। ফলে এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির উপকার হওয়া তো দূরের কথা উল্টো ব্যবস্থাকারীগণ গুনাহগার হয়ে থাকে।
সুতরাং ঈসালে সাওয়াবের প্রশ্নোক্ত পন্থা সম্পূর্ণরূপে পরিহারযোগ্য। মৃতের মাগফিরাত কামনা ও তাকে সাওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগতভাবে দান-সদকা, তেলাওয়াত, যিকির-আযকার ও নফল ইবাদতই যথেষ্ট এবং এটাই করণীয়। আর নির্দিষ্ট কোনো দিন-তারিখের অপেক্ষা না করে নিজ নিজ তাওফীক অনুযায়ী এগুলো মাঝে মধ্যেই করা দরকার। দান-সদকা করার ক্ষেত্রে গরীব দুঃখীদেরকে নগদে প্রদান করা ভালো এবং সদকায়ে জারিয়া হয় এমন খাতে ব্যয় করা উত্তম।
-মুসনাদে আহমদ ২/২০৪; ইবনে মাজাহ পৃ. ১১৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/১৭০; শিফাউল আলীল ১/১৭৫; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ১/৮১; রদ্দুল মুহতার ২/২৪০