বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
—
যে কোনও শাস্ত্র বোঝার জন্যে কিছু পরিভাষা জানা প্রয়োজন। কোনও বই পড়ার আগে, লেখকের উদ্দেশ্য ও রীতিনীতি সম্পর্কে ধারনা থাকা জরুরী। তাহলে শাস্ত্র অধ্যয়ন বা বইপাঠ ফলপ্রসূ হয়। কুরআন কারীম বোঝার জন্যেও কিছু পরিভাষা জানা থাকা ভালো।
আমরা একে একে ১৬-টি পরিভাষা (اصطلاح) বলবো। পরিভাষাগুলো ভালো করে জানা থাকলে, পরবর্তী আলোচনাগুলো বোঝা সহজ হয়ে যাবে। আর হাঁ, পরিভাষাগুলো মাদরাসা পড়ুয়াদের জন্যে। অন্যদের বুঝতে হয়তো কষ্ট হবে। চেষ্টা করবো যাতে সবাই বুঝতে পারে। সহজ ভাষায় বলার জন্যে পাক্কা তিন বছর অপেক্ষা করেছি। নইলে, পরিভাষাগুলো আরও তিন বছর আগে বলার জন্যে বসেছিলাম। তিন বছর আগে, লিখতে বসে দেখলাম সহজ করে বলতে পারছি না, তাই ক্ষান্ত হয়েছিলাম। এবারও যে পারছি, তা নয়। কিন্তু আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। নেমে পড়ি। আল্লাহ তা‘আলাই আসান করে দেবেন। ইনশাআল্লাহ।
১: ১: দাওয়া (دعوى)
প্রতিটি সূরার এক বা একাধিক মূল আলোচ্য বিষয় থাকে। এটাকে ‘দাওয়া’ বা সূরার মাওদু (موضوع) মানে সূরার মারকাযী মাযমুন (مركزي مضمون) বলা হয়। এই মারকাযী মাযমুন (মূল আলোচ্যবিষয়)-ই সূরার কেন্দ্রবিন্দু (محور)। সূরার সমস্ত আলোচ্যবিষয় ‘মারকাযী মাযমূন’কে ঘিরে আবর্তিত হয়।
এর উদাহরণ বীজের মতো। গাছের প্রতিটি শাখা প্রশাখা, পত্র-পল্লবে বীজের প্রভাব বিদ্যমান থাকে। এ-কারণে এক জাতের গাছ আরেক জাতের গাছ থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। প্রতিটি সূরার ‘দাওয়া’ বা মারকাযী মাযমুনও বীজের মতো। সূরার প্রতিটি আয়াতে, ‘দাওয়ার’ প্রভাব বিদ্যমান থাকে।
সূরা বাকারার মূল দাওয়া বা মারকাযী মাযমুন হল ‘তাওহীদের আহ্বান’। সেটা এই আয়াতের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর (বাকারা ২১)।
.
আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছে। তাওহীদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। সূরা বাকারার প্রতিটি আয়াতই
কোনও না কোনওভাবে এই দাওয়া বা মারকাযী মাযমূনের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতিটি আয়াতই কোনও না কোনওভাবে তাওহীদের দাওয়াতের সাথে জড়িত।
আলকুরআন বোঝার মূলনীতি: ২
আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে, তাওহীদ বোঝানোর জন্যে প্রতিটি সূরায় এক বা একাধিক দাবী উপস্থাপন করেছেন। শুধু দাবিই করেননি, সাথে সাথে দলীলও পেশ করেছেন। আমাদের দ্বিতীয় পরিভাষার নাম
২: ‘দলীল’ (دليل)।
যে বক্তব্য দ্বারা উত্থাপিত দাবীর সত্যতা প্রমাণ করা হয়, তাকে দলীল বলা হয়।
দাওয়া বা দাবীকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআন কারীমে তিন প্রকারের দলীল পেশ করেছেন।
১: আকলী (عقلي)। বৃদ্ধিবৃত্তিক।
২: নকলী (نقلي)। উদ্ধৃতি বা বর্ণনামূলক।
৩: ওহী (وحي)। আল্লাহর পক্ষ থেকে।
.
আকলী দলীল দুই প্রকার:
ক: নিখাদ বুদ্ধিবৃত্তিক (عقلي محضة) দলীল।
সুস্থ যুক্তিবোধ দলীলটা শুনেই মেনে নেয়। বাড়তি মৌখিক স্বীকৃতির প্রয়োজন হয় না। দাবি ছিল,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করো,
الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদেরকে, যাতে তোমরা মুত্তাকী হয়ে যাও (বাকারা ২১)।
কেন ইবাদত করবে? তার স্বপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল দেয়া হয়েছে। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন আরও অনেক কিছু করেছেন, তার এবাদত কেন করবে না?
এই দলীলে প্রতিপক্ষ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়নি। জানা কথা, স্বীকারোক্তি আদায় করার দরকার নেই। প্রতিপক্ষ এই দলীলকে মেনে নেবেই।
.
খ: প্রতিপক্ষের স্বীকারোক্তিমূলক বুদ্ধিবৃত্তিক ( عقلي مع اعتراف الخصم) দলীল।
সুস্থ যুক্তিবোধ দলীলটা শুনেই মেনে নেয়, পাশাপাশি (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) স্বীকারোক্তিও দেয়।
দলীলটা অবিশ্বাসী বিপক্ষের সামনে প্রশ্নাকারে পেশ করা হয়। দলীল শোনার পর বিপক্ষের মেনে নেয়ার ভঙ্গি দেখে, প্রশ্নের উত্তরও সাথে সাথে বলে দেয়া হয়।
قُلْ مَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّن يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَن يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ الْأَمْرَ ۚ
(হে নবী! মুশরিকদেরকে বলে দিন, কে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে রিযক সরবরাহ করেন? অথবা কে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির মালিক? এবং কে মৃত হতে জীবিতকে এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? এবং কে যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন? এবং কে যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন?
প্রশ্নের আঙ্গিকে বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল পেশ করা হয়েছে। তারা উত্তর না দিয়ে থাকতে পারেনি। স্বীকার করে বসেছে।
فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ ۚ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
তারা বলবে, আল্লাহ! বলুন, তবুও কি তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে না? (ইউনুস ৩১)।
.
নকলী দলীল ৭ প্রকার:
১: নবীগন থেকে নকল।
তাওহীদের দাওয়াত পেশ করার পর, দাবীকে সুদৃঢ় করার জন্যে, কোনও উদ্ধৃতি বা ঘটনা বর্ণনা করা। বোঝানোর জন্যে, তাওহীদের এমন দাবী আমিই প্রথম তুলিনি, আমার আগে আরও জাতি ও ব্যক্তিও এই তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন করে গেছেন। তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে গেছেন।
.
এটা দুই প্রকার
ক: সংক্ষিপ্ত (إجمالي)।
দলীলে সুনির্দিষ্ট কোনও নবীর নাম উল্লেখ না করে, তাদের কথা বা অবস্থা বর্ণনা করা।
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ
আমি আপনার পূর্বে এমন কোনও রাসূল পাঠাইনি, যার প্রতি আমি এই ওহী নাযিল করিনি যে,
لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
‘আমি ছাড়া অন্য কোনও মাবুদ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত করুন (আম্বিয়া ২৫)।
প্রতিটি নবীই একথার দাওয়াত দিয়ে গেছেন।
.
খ: বিস্তারিত (تفصيلي)।
নবী বা নবীগণের নাম উল্লেখ করে উক্তি বা অবস্থা বর্ণনা করা হবে।
وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ قَالَ يَا قَوْمِ
আর আদ জাতির কাছে আমি তাদের ভাই হুদকে (পাঠাই)। সে বলল, হে আমার কওম!
اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ ۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ
আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনও মাবুদ নেই। তবুও কি তোমরা (আল্লাহকে) ভয় করবে না? (আ‘রাফ ৬৫)।
.
সুনির্দিষ্ট একজন নবীর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। তার দাওয়াতে তাওহীদের ‘বাক্য’ তুলে ধরা হয়েছে।
.
২: পূর্ববর্তী কিতাব থেকে নকল।
وَآتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَجَعَلْنَاهُ هُدًى لِّبَنِي إِسْرَائِيلَ
এবং আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, এবং তাকে বনী ইসরায়েলের জন্যে হিদায়াতের মাধ্যম বানিয়েছিলাম। আদেশ করেছিলাম,
أَلَّا تَتَّخِذُوا مِن دُونِي وَكِيلًا
তোমরা আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে কর্মবিধায়করূপে গ্রহণ করো না (ইসরা ২)।
তাওরাত থেকে উদ্ধৃতি পেশ করা হয়েছে।
.
৩: পূর্ববর্তী কিতাবের অনুসারীদের থেকে।
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَٰئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ
যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা যখন তা তিলাওয়াত করে, যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত, তখন তারাই তার প্রতি (প্রকৃত) ঈমান রাখে। আর যারা তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত লোক (বাকারাহ ১২১)।
.
আগে যত জাতিকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকেই তার তিলাওয়াত করত। এবং কিতাবে বর্ণিত ‘তাওহীদে’ বিশ^াস করত।
.
৪: ফিরিশতা থেকে।
فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
সুতরাং ( হে মানুষ!) তোমরা আল্লাহকে ডাক তার জন্যে আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে (গাফের ১৪)।
.
এটা ছিল তাওহীদের স্বপক্ষে ‘দাওয়া’। ফিরিশতারাও আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন করে, তার ইবাদত করে। তার কাছে দু‘আ করে।
الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آمَنُوا
যারা (অর্থাৎ যে ফেরেশতাগণ) আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চারপাশে আছে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে তাঁর তাসবীহ পাঠ করে ও তাঁর প্রতি ঈমান রাখে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্যে মাগফিরাতের দু‘আ করে (যে,)
رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَّحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার রহমত ও জ্ঞান সমস্ত কিছু জুড়ে ব্যাপ্ত। সুতরাং যারা তাওবা করেছে ও আপনার পথের অনুসারী হয়েছে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন (গাফের ৭)।
.
ফিরিশতাদের এই দু‘আর দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, তারাও আকীদায়ে তাওহীদে বিশ^াস করে। না হলে, তারা আল্লাহর কাছে দু‘আ করবে কেন?
হে মুশরিকরা! দেখেছ, ফিরিশতারাও তাওহীদে বিশ^াস করে? আর তোমরা তাদেরকে আল্লাহর ‘কন্যা’ ঠাউরে বসে আছো?
.
৫: জি¦ন থেকে।
قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الْجِنِّ فَقَالُوا
(হে রাসূল!) বলে দিন, আমার কাছে ওহী এসেছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে (কুরআন) শুনেছে অতঃপর (নিজ সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে) বলেছে,
إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا يَهْدِي إِلَى الرُّشْدِ فَآمَنَّا بِهِ ۖ
আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। সুতরাং আমরা তার প্রতি ঈমান এনেছি।
.
কুরআন শুনেই তারা তাওহীদের দাওয়াত পেয়ে গেছে। সাথে সাথে তাওহীদে বিশ^াস স্থাপন করে ফেলেছে। দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিয়েছে,
وَلَن نُّشْرِكَ بِرَبِّنَا أَحَدًا
এখন আর আমরা আমাদের প্রতিপালকের সাথে (ইবাদতে) কখনও কাউকে শরীক করব না (জি¦ন ১-২)।
.
৬: পাখি থেকে।
وَتَفَقَّدَ الطَّيْرَ فَقَالَ مَا لِيَ لَا أَرَى الْهُدْهُدَ أَمْ كَانَ مِنَ الْغَائِبِينَ لَأُعَذِّبَنَّهُ عَذَابًا شَدِيدًا أَوْ لَأَذْبَحَنَّهُ أَوْ لَيَأْتِيَنِّي بِسُلْطَانٍ مُّبِينٍ فَمَكَثَ غَيْرَ بَعِيدٍ فَقَالَ أَحَطتُ بِمَا لَمْ تُحِطْ بِهِ وَجِئْتُكَ مِن سَبَإٍ بِنَبَإٍ يَقِينٍ إِنِّي وَجَدتُّ امْرَأَةً تَمْلِكُهُمْ وَأُوتِيَتْ مِن كُلِّ شَيْءٍ وَلَهَا عَرْشٌ عَظِيمٌ
এবং সে (সুলাইমান একবার) পাখিদের সন্ধান নিলেন। বললেন, কী ব্যাপার! হুদহুদকে দেখছি না যে? সে কি অনুপস্থিত না কি? আমি তাকে কঠিন শাস্তি দেব অথবা তাকে যবাহ করে ফেলব- যদি না সে আমার কাছে স্পষ্ট কোনও কারণ দর্শায়। তারপর হুদহুদ বেশি দেরি করল না এবং (এসে) বলল, আমি এমন বিষয় জেনেছি, যা আপনার জানা নেই। আমি আপনার কাছে ‘সাবা’ দেশ থেকে নিশ্চিত সংবাদ দিয়ে এসেছি। আমি সেখানে এক নারীকে সেখানকার লোকদের উপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সর্বপ্রকার আসবাব-উপকরণ দেওয়া হয়েছে। আর তার একটি বিরাট সিংহাসনও আছে।
.
তাদের শিরকের ব্যাপারটাও হুদহুদ বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছে,
وَجَدتُّهَا وَقَوْمَهَا يَسْجُدُونَ لِلشَّمْسِ مِن دُونِ اللَّهِ
আমি সেই নারী ও তার সম্প্রদায়কে দেখেছি আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যের সিজদা করছে।
.
হুদহুদ তাদের শিরকে লিপ্ত হওয়ার কারণটাও ধরে ফেলেছে,
وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ فَصَدَّهُمْ عَنِ السَّبِيلِ فَهُمْ لَا يَهْتَدُونَ
শয়তান তাদের কাছে, তাদের কার্যকলাপকে শোভনীয় করে দেখিয়েছে। এভাবে সে তাদেরকে সঠিক পথ থেকে নিবৃত্ত রেখেছে, ফলে তারা হেদায়াত পাচ্ছে না।
.
শুধু আল্লাহকেই কেন সিজদা করব? তার স্বপক্ষে হুদহুদ চমৎকার কারণ উল্লেখ করেছে!
أَلَّا يَسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي يُخْرِجُ الْخَبْءَ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَيَعْلَمُ مَا تُخْفُونَ وَمَا تُعْلِنُونَ
(সে তাদেরকে নিবৃত্ত রেখেছে), যাতে তারা সিজদা না করে আল্লাহকে, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর গুপ্ত বিষয়াবলী প্রকাশ করেন এবং তোমরা যা গোপন কর ও যা প্রকাশ কর সবই জানেন (নামল ২০-২৫)।
.
যিনি সবকিছু জানেন, একমাত্র তার ইবাদত করবে না-ই-বা কেন?
.
৭: কীট-পতঙ্গ থেকে।
وَحُشِرَ لِسُلَيْمَانَ جُنُودُهُ مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ وَالطَّيْرِ فَهُمْ يُوزَعُونَ حَتَّىٰ إِذَا أَتَوْا عَلَىٰ وَادِ النَّمْلِ قَالَتْ نَمْلَةٌ يَا أَيُّهَا النَّمْلُ ادْخُلُوا مَسَاكِنَكُمْ لَا يَحْطِمَنَّكُمْ سُلَيْمَانُ وَجُنُودُهُ
সুলাইমানের জন্যে তার সৈন্য সমবেত করা হয়েছিল যা ছিল জিন, মানুষ ও পাখি-সম্বলিত। তাদেরকে রাখা হত নিয়ন্ত্রণে। একদিন যখন তারা পিঁপড়ের উপত্যকায় পৌঁছল, তখন এক পিঁপড়ে বলল, ওহে পিঁপড়েরা! নিজ ঘরে ঢুকে পড়, পাছে সুলাইমান ও তার সৈন্যরা তাদের অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষে ফেলে (নামল ১৭-১৮)।
.
এখানে পিঁপড়া কোথায় তাওহীদের স্বপক্ষে দলীল দিল? আয়াতের একেবারে শেষে আছে,
وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ
তারা টেরও পাবে না।
পিঁপড়া বোঝাতে চেয়েছে, গাইবের জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। সুলাইমান নবী হলেও, গাইবের জ্ঞান রাখে না। শুধু সুলাইমান কেন, গাইবের জ্ঞান আল্লাহর ছাড়া আর কারো কাছেই নেই। এটাই ‘আকীদায়ে তাওহীদ’।
.
৩: ওহীর দলীল (دليل وحي)।
দাওয়া ও দাওয়ার স্বপক্ষে দলীল পেশ করার সাথে সাথে নবীজি সা. এও বলে দেন, আমি যা বলছি, নিজের থেকে বলছি না। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে এটা বলার আদেশ করা হয়েছে বলেই বলছি।
قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَمَّا جَاءَنِيَ الْبَيِّنَاتُ مِن رَّبِّي وَأُمِرْتُ أَنْ أُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
غافر ৬৬
(হে রাসূল! কাফেরদেরকে) বলে দিন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের ইবাদত করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে যখন আমার কাছে আমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী এসে গেছে। আর আমাকে আদেশ করা হয়েছে, আমি যেন জগতসমূহের প্রতিপালকের সামনে আনুগত্য স্বীকার করি (গাফের ৬৬)।
.
আল্লাহর রাসূল বলছেন, আমি একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে বাধ্য। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে, আমাকে এর ব্যতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন।
.
.
কুরআন কারীমে তাওহীদের দাবীকে তিন প্রকার দলীল দ্বারাই প্রমাণ করা হয়েছে। তাওহীদকে অস্বীকার করার কোনও উপায়ই খোলা রাখা হয়নি। শিরকের যাবতীয় সম্ভবনাকে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। তিন প্রকার দলীল পেশ করার উদ্দেশ্য ভিন্ন,
১: আকলী দলীল পেশ করা হয় যাতে, সুস্থ চিন্তা ও সুস্থ যুক্তিবোধ সহজেই তাওহীদ বুঝতে সক্ষম হয়। কুরআন কারীমের ‘আকলী দলীলগুলো’ সাধারণত অত্যন্ত সহজবোধ্য হয়ে থাকে। যেই শুনবে, সাথে সাথে, মেনে নিতে বাধ্য হবে, তাই তো! তিনি রাব্ব না হয়ে আর কে হবেন?
২: দলীলে নকলী: পেশ করা হয় যাতে বোঝা যায়, তাওহীদের দাওয়াত শুধু আমাদের নবীজি সা.-ই দেননি, পূর্বেকার সমস্ত নবী-রাসূলও তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন।
৩: দলীলে ওহী পেশ করা হয় একটা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্যে। তাওহীদের দাওয়াত অস্বীকারকারীরা আপত্তি তোলে,
-দুনিয়াতে আরও কত বিষয় আছে, কত কিছু আছে, সেসব ফেলে তুমি শুধু এই ‘তাওহীদ’ নিয়ে পড়ে আছ কেন? চলো, আমাদেরকে অন্য কিছু শোনাও!
এর জবাবেই বলা হয়,
-আমি তাওহীদের দাওয়াত নিজ থেকে দিচ্ছি না। আমাকে ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেই তাওহীদের দাওয়াতে নিজেকে নিয়োজিত করেছি।
.
.
আমাদের দ্বিতীয় পরিভাষা (এস্তেলাহটি) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিভাষাটি বুঝতে পারলে, কুরআন কারীমের অসংখ্য আয়াত পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।
কুরআন বোঝার মূলনীতি: ৩
দাবীকে আলোকিতকরণ (تَنوِيرِ دَعْوَى)।
.
যারা তাওহীদের দাওয়াকে অস্বীকার করে, তাদের সামনে ‘দাওয়ার’ কিছু অংশ উপস্থাপন করা হয়। ওটুকু মেনে নিলে, দাওয়ার বাকি অংশ উল্লেখ করা হয়। ভাবটা এমন, আগেরটা যেহেতু মেনেছ, এটুকুও মেনে নাও! উভয়টা এক কথাই তো!
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ
আপনি যদি তাদেরকে (মুশরিকদেরকে) জিজ্ঞেস করেন, আকাশম-লী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছে?
.
তারা একবাক্যে উত্তর দিয়েছে,
لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ
তবে তারা অবশ্যই বলবে, এগুলো সৃষ্টি করেছেন সেই পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)।
স্বীকারোক্তি আদায় করার পর, সামনে বাড়া হচ্ছে! একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করতে হবে। তোমরা তাকে পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ বলে বিশ^াস করছ! তিনি তো এমন,
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ مَهْدًا وَجَعَلَ لَكُمْ فِيهَا سُبُلًا لَّعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ وَالَّذِي نَزَّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ فَأَنشَرْنَا بِهِ بَلْدَةً مَّيْتًا ۚ كَذَٰلِكَ تُخْرَجُونَ وَالَّذِي خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا وَجَعَلَ لَكُم مِّنَ الْفُلْكِ وَالْأَنْعَامِ مَا تَرْكَبُونَ
যিনি তোমাদের জন্যে ভূমিকে বানিয়েছেন বিছানা এবং তোমাদের জন্যে তাতে বিভিন্ন পথ সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার। যিনি আসমান থেকে বারি বর্ষণ করেন পরিমিতভাবে। তারপর আমি তার মাধ্যমে এক মৃত অঞ্চলকে নতুন জীবন দান করি। এভাবেই তোমাদেরকে (কবর থেকে) বের করে নতুন জীবন দান করা হবে (যুখরুফ ৯-১১)।
.
তিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, এটা যখন মানো বাকিটুকুও তাহলে মেনে নাও!
.
কখনো এমন হয়, একটা মাসয়ালা বর্ণনা করার পর, সে মাসয়ালার কোনও অংশকে আরেকটু বেশি স্পষ্ট করার জন্যে বাড়তি আলোচনার অবতারণা করা হয়। অথবা সে মাসয়ালা থেকে উদ্ভূত সন্দেহকে দূর করার জন্যেও পরে নতুন করে আলোচনা করা হয়। এটাও একপ্রকার ‘তানভীর’।
সূরা নিসার ১২৭-তম আয়াতে তানভীর করা হয়েছে তৃতীয় আয়াতের।
কুরআন বোঝার মূলনীতি: ৪
ভীতি প্রদর্শন (تَخْوِيْف)।
.
দাওয়ায়ে তাওহীদ মানানোর জন্যে, অথবা কেউ তাওহীদ মানতে না চাইলে, আল্লাহ তা‘আলা আযাবের ভয় দেখান। এটাই ‘তাখভীফ’।
.
দুই প্রকার
১: দুনিয়াবি ভীতি প্রদর্শন (تخويف دُنْيُوِي)।
ভীতি প্রদর্শনটা দুনিয়া সম্পর্কিত হবে।
وَكَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُم مِّن قَرْنٍ هَلْ تُحِسُّ مِنْهُم مِّنْ أَحَدٍ أَوْ تَسْمَعُ لَهُمْ رِكْزًا
مريم ৯৮
তাদের আগে আমি কত মানব-গোষ্ঠীকেই ধ্বংস করেছি। আপনি কি হাতড়িয়েও তাদের কারও সন্ধান পান কিংবা আপনি কি তাদের কোনও সাড়া শব্দ শুনতে পান? (মারয়াম ৯)।
২: আখেরাতের ভীতি প্রদর্শন (تَخْوِيْف أُخْرُوِيْ)।
ভীতি প্রদর্শনটা আখেরাত সম্পর্কিত হবে।
وَنَسُوقُ الْمُجْرِمِينَ إِلَىٰ جَهَنَّمَ وِرْدًا
مريم ৮৬
আর অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত অবস্থায় হাঁকিয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাব (মারয়াম ৮৬)।
.
শাহ ওয়ালি উল্লাহ রহ.
প্রথমটিকে বলেছেন, (تَذْكِيْر بِأيَّامِ الله) আল্লাহর দিনগুলো সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
দ্বিতীয়টিকে বলেছেন, (تَذْكِيْر بِما بَعْدَ المَوْت) মৃত্যু পরবর্তী আযাব সম্পর্কে সতর্কীকরণ।
-আলফাওযুল কাবীর।
.
কুরআন কারীমের আখেরাতের আযাব ও পূর্বের জাতিসমূহের ধ্বংস সম্পর্কিত যত আয়াত আছে, সবগুলোকে আমরা এই পরিভাষার আওতায় নিয়ে আসতে পারি।
.
একটা পরিভাষা আরেকটার সাথে সম্পর্কিত। আগের পরিভাষা ছিল, তানভীরে দাওয়া। দলীলের মাধ্যমে দাবীবে দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করার পরও যদি তোমরা ‘তাওহীদ’ মানতে রাজি না হও, তাহলে তোমাদের জন্যে ‘আযাব’ (তাখভীফ) দেয়া হবে।
কুরআন বোঝার মূলনীতি: ৫
সুসংবাদদান (تبشير)।
.
তাখভীফের বিপরীতে ‘তাবশীর’। তাওহীদের দাওয়াত যারা মানে, তাদের জন্যে পুরষ্কারের সুসংবাদ প্রদান করা হয়।
.
দুই প্রকার:
১: দুনিয়াবী।
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ ۚ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا
যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, এবং আপনি মানুষকে দেখবেন দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে, তখন আপনি আপনার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করবেন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল (নাসর)।
.
দুনিয়াবি সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
.
২: উখরভী (أُخرُوي)।
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا
(অপর দিকে) যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে তাদের আপ্যায়নের জন্যে অবশ্যই ফিরদাওসের উদ্যান রয়েছে (মারয়াম ১০৭)।
.
আকীদায়ে তাওহীদ গ্রহণ করার পরিণতি হিশেবে, আখেরাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
.
উল্লেখ্য,
কুরআন কারীমে দুনিয়াবী সুসংবাদ (تَبْشِير) খুবই কম। দুনিয়া মুমিনের আসল ঠিকানা নয়। মুমিনের আসল ঠিকানা আখেরাত। তাই কুরআন কারীমের বেশির ভাগ জায়গায় প্রত্যক্ষ বা অপত্যক্ষভাবে আখেরাতের আলোচনা। আখেরাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। দুনিয়ার প্রাপ্তিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
.
দুনিয়ার রাজা-বাদশারা তাদের অনুগত প্রজাকে পুরষ্কৃত করে। বিদ্রোহী প্রজাকে তিরষ্কৃত করে। আল্লাহ তা‘আলাও তার অনুগত বান্দাদেরকে পুরষ্কৃত করেন। অবাধ্য বান্দাদেরকে তিরষ্কৃত করেন।
কুরআন বোঝার মূলনীতি: ৬
শাকওয়া (شَكْوى)। অভিযোগ।
দলীল অকাট্য যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরও, কাফেররা হক মেনে নিতে চায় না। বরং উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করে। এ কথাগুলোকেই শাকওয়া বলা হয়।
শাকওয়া সাধারণত শুরু হয় (قالَ) বা (قَالُوا) দিয়ে।
.
দুই প্রকার:
ক: শাকওয়ার সাথে শাকওয়ার জবাবও থাকবে,
وَقَالُوا لَن نُّؤْمِنَ لَكَ حَتَّىٰ تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْأَرْضِ يَنبُوعًا أَوْ تَكُونَ لَكَ جَنَّةٌ مِّن نَّخِيلٍ وَعِنَبٍ فَتُفَجِّرَ الْأَنْهَارَ خِلَالَهَا تَفْجِيرًا أَوْ تُسْقِطَ السَّمَاءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَيْنَا كِسَفًا أَوْ تَأْتِيَ بِاللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ قَبِيلًا أَوْ يَكُونَ لَكَ بَيْتٌ مِّن زُخْرُفٍ أَوْ تَرْقَىٰ فِي السَّمَاءِ وَلَن نُّؤْمِنَ لِرُقِيِّكَ حَتَّىٰ تُنَزِّلَ عَلَيْنَا كِتَابًا نَّقْرَؤُهُ ۗ
তারা বলে, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার প্রতি ঈমান আনব না, যতক্ষণ না তুমি ভূমি থেকে আমাদের জন্যে এক প্রস্রবণ বের করে দেবে। অথবা তোমার জন্যে খেজুর ও আঙ্গুরের একটি বাগান হয়ে যাবে এবং তুমি তার ফাঁকে ফাঁকে মাটি ফেড়ে নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবে। অথবা তুমি যেমন দাবি করে থাক, আকাশকে খন্ডবিখণ্ড করে আমাদের উপর ফেলে দেবে কিংবা আল্লাহ ও ফিরিশতাদেরকে আমাদের সামনা-সামনি দিয়ে আসবে। অথবা তোমার জন্যে একটি সোনার ঘর হয়ে যাবে অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে, কিন্তু আমরা তোমার আকাশে আরোহণকেও ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি এমন এক কিতাব অবতীর্ণ করবে, যা আমরা পড়তে পারব।
.
এটা ছিল দুষ্ট মুশরিকদের ‘শাকওয়া’ বা অভিযোগমূলক চাহিদার ফিরিস্তি। ছোট্ট একটা বাক্যে তার জবাব দেয়া হয়েছে,
قُلْ سُبْحَانَ رَبِّي هَلْ كُنتُ إِلَّا بَشَرًا رَّسُولًا
(হে নবী!) বলে দিন, আমার প্রতিপালক পবিত্র। আমি তো একজন মানুষ মাত্র, যাকে রাসূল করে পাঠানো হয়েছে (ইসরা ৯০-৯৩)।
.
নবীর কাজ দাওয়াত দেয়া। তোমরা যেসব দাবী তুলেছ, সেসব আঞ্জাম দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।
.
খ: শাকওয়ার সাথে জাওয়াব উল্লেখ থাকবে না।
وَقَالُوا قُلُوبُنَا فِي أَكِنَّةٍ مِّمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ وَفِي آذَانِنَا وَقْرٌ وَمِن بَيْنِنَا وَبَيْنِكَ حِجَابٌ فَاعْمَلْ إِنَّنَا عَامِلُونَ
(রাসূলকে) তারা বলে, তুমি আমাদেরকে যার দিকে ডাকছ, সে বিষয়ে আমাদের অন্তর গিলাফে ঢাকা, আমাদের কান বধির এবং আমাদের ও তোমার মাঝখানে আছে এক অন্তরাল। সুতরাং তুমি আপন কাজ করতে থাক আমরা আমাদের কাজ করছি (ফুসসিলাত ৫)।
.
আরেকটি উদাহরণ দেখি,
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ
এবং কাফেররা (একে অন্যকে) বলে, এই কুরআন শুনো না এবং এর (পাঠের) মাঝে হট্টগোল কর, যাতে তোমরা জয়ী থাক (ফুসসিলাত ২৬)।
.
দুই আয়াতেই কাফেরদের অভিযোগ বর্ণনা করা হয়েছে। তবে অভিযোগের জবাব দেয়া হয়নি।
কুরআন বোঝার মূলনীতি: ৭
ধমক (زَجْر)।
দুই প্রকার
১: অবিশ্বাসীদেরকে ধমক।
তাওহীদের দাওয়ার অবিশ্বাসীরা অনেক সময় অযৌক্তিক দাবি করে বসে, তারা নানাবিধ গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তখন তাদেরকে ধমক দেন।
فَلَمَّا جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُم بِالْبَيِّنَاتِ فَرِحُوا بِمَا عِندَهُم مِّنَ الْعِلْمِ وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ
সুতরাং তাদের রাসূলগণ যখন তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আসল, তখনও তারা তাদের কাছে যে জ্ঞান ছিল তারই বড়াই করতে লাগল। ফলে তারা যাা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত তাই তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলল (গাফের ৮৩)।
.
২: নবীগন কখনো, অনুত্তম (خلاف أولي) কাজ করেন। মানে কাজটা গুনাহ নয়, আবার উত্তমতরও নয়। নবীগণ এমন কোনও আচরণ/উচ্চারণ করে ফেললে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা আসে। এটাকে তাম্বীহ (تَنْبِيْه) বলা হয়।
قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ ۖ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ ۖ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ۖ إِنِّي أَعِظُكَ أَن تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ
আল্লাহ বললেন, হে নূহ! জেনে রেখ, সে তোমার পরিবারবর্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। সে তো অসৎকর্মে কলুষিত। সুতরাং তুমি আমার কাছে এমন কিছু চেও না, যে সম্পর্কে তোমার কোনও জ্ঞান নেই। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি তুমি অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না (হুদ ৪৬)।
.
নূহ আ. স্বীয় মুশরিক সন্তানের জন্যে আল্লাহর কাছে আবেদন করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, মুশরিক সন্তান নবীর পরিবারভুক্ত হয়ে পারে না।
.
عَفَا اللَّهُ عَنكَ لِمَ أَذِنتَ لَهُمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَتَعْلَمَ الْكَاذِبِينَ
(হে নবী!) আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কারা সত্যবাদী আপনার কাছে স্পষ্ট হওয়া এবং কারা মিথ্যাবাদী তা না জানা পর্যন্ত আপনি তাদেরকে (জিহাদে শরীক না হওয়ার) অনুমতি কেন দিলেন? (তাওবা ৪৩)।
.
মুনাফিকরা যুদ্ধে যাওয়া থেকে বাঁচার জন্যে, মিথ্যা অজুহাত নিয়ে নবীজি সা.-এর এল। নবীজি তাদের অজুহাত গ্রহণ করে যুদ্ধযাত্রা থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দিলেন। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা নবীজিকে সতর্ক করেছেন।
.
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
হে নবী! আল্লাহ যে জিনিস আপনার জন্যে হালাল করেছেন, আপনি নিজ স্ত্রীদেরকে খুশি করার জন্যে তা হারাম করছেন কেন? আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (তাহরীম ১)।
.
স্ত্রীদের কারণে, হালাল মধুকে নিজের উপর হারাম করে নিয়েছিলেন নবীজি। আল্লাহ তা‘আলা এজন্য সতর্ক করে দিয়েছেন।
কুরআন বোঝার মূলনীতি: ৮
সান্ত্বনা (تَسْلِيَة)।
.
তাওহীদের দাওয়াত দিতে গিয়ে, কাফেরদের গালি-গালাজ, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, নির্যাতন, হয়রনির শিকার হতে হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন আয়াতে এর প্রেক্ষিতে সান্ত্বনা দিয়েছেন।
.
সান্ত্বনার ধরনটা স্বাভাবিক হবে।
وَإِن يُكَذِّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ ۚ
এবং (হে রাসূল!) তারা যদি আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে আপনার পূর্বেও রাসূলগণকে মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল (ফাতির ৪)।
.
নবীজিকে মুশরিকরা মিথ্যাবাদী বলতো। আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতে নবীজি সা.-কে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আবার কখনো সান্ত¡না দেয়ার আগে, একটু সতর্কও করে দিয়েছেন,
لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ
আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন লোককে মজা লোটার যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি তার দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না এবং তাদের প্রতি মনোক্ষুন্ন হবেন না। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্যে আপনার (বাৎসল্যের) ডানা নামিয়ে দিন (হিজর ৮৮)।
.
প্রথমে একটু সতর্ক করেছেন। তারপর সান্ত্বনাবাক্য শুরু করেছেন।
আতিক উল্লার ফেইসবুক পাতা থেকে।