দিন যায় মাস আসে। একদিন মাসও চলে যায়-হারিয়ে যায় স্মৃতির পাতা থেকে। কিন্তু কখনো কোন মাসে এমন কিছু ঘটনা সংগঠিত হয়, যা এই মাসটিকে স্মরণীয় করে রাখে।
১২ই রবিউসসানী মোতাবিক ১৬ আগষ্ট ১৯৯৭ ইং শনিবার, বাংলাদেশের দাওয়াতী ও দ্বীনি ইতিহাসের এমন একটি দিন, যে দিনটিকে বহুকাল পর্যন্ত দু:খ ও ব্যাথা-বেদনার সাথে স্মরণ করা হবে। এ দিনেই নশ্বর পৃথিবী থেকে পরম করুণাময়ের দরবারে লাব্বাইক বলে উপস্থিত হয়েছেন ময়দানে বেলায়েতের অশ্বারোহী, চিশতিয়া সিলসিলার আমীন, জমীরী ও আজীজী ইলম-মারিফাতের উত্তরাধিকারী, সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুরুব্বী ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা সোলতান আহমদ নানুপুরী রহ.।
মানবজাতির পিতা হযরত আদম আ. থেকে আজ পর্যন্ত ধরার বুকে কত যে মানুষ এসেছে এবং চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছে, তার কোন শুমার নেই। কিন্তু এ বিশ্বজগতে এমন কিছু লোকও আগমন করে থাকেন, যাদের শারীরিক মৃত্যু খোদায়ী বিধাননুযায়ী অবশ্যই ঘটে থাকে, তবে ঘটে না তাঁদের কীর্তি সাধনার মৃত্যু: তাঁদের ইতিহাস হয় অবিস্মরনীয়। ইতিহাসের মহাপুরুষগণেরই অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন হযরত নানুপুরী হুজুর রহ.।
হযরত নানুপুরী সাহেব রহ. প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা স্বদেশে অর্জন করে মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা কেন্দ্র দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন। দেওবন্দে তাঁর ওস্তাদবৃন্দের মধ্যে শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ. (মৃত্যু- ১৩৭৭হি.)।
আল্লামা ইব্রাহিম বলয়াভী (মৃত্যু- ১৩৮৭) রহ. এর প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত অনুরাগী ও আশেক। তাঁর মাহফিলে মাওলানা মাদানী রহ. এর বেশকিছু মূল্যবান কথা ও নসীহত শুনার এ অধমের সুযোগ হয়েছে। মরহুম আব্বাজানের মূল্যবান কথা ও নসীহত শুনার এ অধমের সুযোগ হয়েছে। মরহুম আব্বাজান মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা আবুল হাসান (মৃত্যু- ১৪১২ হি.) এর সাথে পাঠ্যজীবন থেকে হযরত নানুপুরী হুজুরের সম্পর্ক ছিল সুগভীর। নানুপুরী হুজুর দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে স্বদেশে ফেরার সময় মরহুম আব্বাজান আপন চাচা নাজিরহাট বড় মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা নুর আহমদ (মৃত্যু- ১৩৯৮ হি.) এর নিকট নানুপুরী হুজুরকে নাজিরহাট মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ করার লক্ষ্যে দেওবন্দ থেকে চিঠি লিখেন। হযরত নানুপুরী হুজুরও প্রায় সময় আব্বাজানের ইলমী দক্ষতার প্রাণ ঢালা প্রশংসা করতেন। নাজিরহাট মাদরাসায় তিনি প্রায় দু’বছর যাবৎ শিক্ষকতা করেন। এখানে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে মাদরাসার সাবেক মুহতামিম মাওলানা হাফেজ শামসুদ্দীন সাহেব, আল্লামা হাফেজ হারুন সাহেব (শাইখুল হাদীস জামিয়া ওবাইদিয়া), মাওলানা মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
অত:পর তিনি জামিয়া ইসলামিয়া বাবুনগরে প্রায় ১৪/১৫ বছর যাবৎ অত্যন্ত সফলতার সাথে শিক্ষকতার কাজ আঞ্জাম দেন। এখানে তিনি মুসলিম শরীফেরও পাঠদান করেছেন। এখানে তাঁর বিশিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে বাবুনগর মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম, হযরত মাওলানা মহিব্বুল্লাহ সাহেবের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ্য যে, জামিয়া বাবুনগরের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদে আযম হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ হারুন (মৃত্যু- ১৪০৬ হি.) এর প্রতি ছিল হযরত নানুপুরী হুজুরের সুগভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। ইলমে বাতেনের সিলসিলায় হযরত বাবুনগরী রহ. এর সোহবত হতে তিনি অনেক কিছু অর্জন করেছেন। ১৪০৬ হিজরীতে অনুষ্ঠিত বাবুনগর মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে হাজার হাজার শ্রোতার উপস্থিতিতে আমার এক ত্রুটির ওপর আমাকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে নানুপুরী হুজুর বলেছেন- এর আগে আমি ১৪/১৫ বছর যাবৎ হযরত মাওলানা হারুন শাহ বাবুনগরী রহ. এর খেদমত করেছি এবং তাঁর জুতার ধুলার বরকত লাভে ধন্য হয়েছি। অন্য এক ওয়ায মাহফিলে দোয়া করার সময় বলেছিলেন- হে আল্লাহ! আমাকে হযরত হারুন সাহেবের বুকের দৌলত দান করুন। মোটকথা, এ দু’মহান বুযুর্গ ব্যক্তিত্বের দ্বীনি ও ঈমানী সম্পর্ক ছিল নজীরবিহীন। হযরত বাবুনগরী রহ. এর বিশিষ্ট খলীফা, প্রখ্যাত লেখক হযরত মাওলানা সুলতান যওক সাহেব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নানুপুর ওবাইদিয়া মাদরাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা সুলতান আহমদ সাহেব নানুপুরী ছিলেন এক সময় বাবুনগর মাদরাসার মুহাদ্দিস। তৎকালে প্রায় তিনি হযরতবাবুনগরী সাহেবের সাথে ওয়ায মাহফিলে গমন করতেন। তিনি তাঁকে একদা বললেন- হুজুর! আমাদের কবে ওয়ায করার যোগ্যতা আসবে? তিনি তাঁকে বলেন- একটু ধৈর্য ধারন কর। ইনশাআল্লাহ, পরে দেখবে লোকদের পীড়াপীড়িতে সময় করা মুশকিল হবে। পরে তাঁর দোয়া সত্য হল। মানুষের ডল ছুটল তাঁর ওয়ায শুনার জন্যে। এমনকি একবার পটিয়া মাদরাসার এক সভায় কুতুবুল ইরশাদ হযরত মুফতী আজীজুল হক সাহেবকে আগ্রহী লোকদের পীড়াপীড়িতে মাইকে ঘোষণা করতে হল তোমরা শান্ত থাক, অমুক সময় মাওলানা সুলতান সাহেবের ওয়ায হবে।
খতীবে ইসলাম হযরত মাওলানা মুজাহেরুল ইসলাম সাহেব (মৃত্যু- ১৪১২হি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- নানুপুরী সাহেব বাবুনগর থাকাকালীন একদা অনাবৃষ্টির কারণে চতুর্পার্শ্বে হাহাকার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন তাঁর চাচাজী হযরত মাওলানা মুসা বুযুর্গ সাহেব (মৃত্যু- ১৪০৩ হি.) জমিতে পানি সিঞ্চন করছিলেন। সে মুহূর্তে নানুপুরী সাহেব ছাত্রদের বললেন- তোমরা অবিলম্বে কাপড়-চোপড় নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়। এক্ষুণিই বৃষ্টি বর্ষণ হবে ইনশাআল্লাহ। কারণ, আল্লাহর বান্দা (হযরত মুসা বুযুর্গ সাহেব) অনাবৃষ্টির দরুন কষ্ট করে পানি সিঞ্চন করছেন। আল্লাহর নিজের প্রিয় বান্দাকে কষ্ট দেবেন না। বৃষ্টি বর্ষণ হবে। সুতরাং তোমরা কাপড়-চোপড় ঘরে নিয়ে যাও। বাস্তবে দেখা গেল কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল।
দীর্ঘদিন যাবৎ জামিয়া বাবুনগরে শিক্ষকতা করার পর পটিয়ার হযরত মুফতী সাহেবের রহ. ইঙ্গিতে নানুপুরী সাহেব হুজুর নানুপুর মাদরাসায় তাশরীফ নিয়ে যান। তাঁরই ইখলাস, রুহানিয়াত, অক্লান্ত সাধনা এবং সুদক্ষ পরিচালনার বদৌলতে সেদিনের মাদরাসাটি আজ জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়া নামে দেশের একটি প্রসিদ্ধ ও বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে, যা কেয়ামত পর্যন্ত হযরতের একটি অবস্মিরণীয় অবদান এবং সদকায়ে জারিয়া হিসেবে বাকী থাকবে ইনশা’আল্লাহ।
হযরত নানুপুরী সাহেবের ব্যক্তিত্বে যে অসংখ্য গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটেছিল, তার দু’একটি বিশেষভাবে এখানে উল্লেখ করছি।
পীর-মুর্শিদ ও আকাবিরগণের প্রতি অনুরাগ ও ভালবাসা:
ইসলামে আসাতিজায়ে কেরাম এবং সালফে সালেহীনের প্রতি ভালবাসার সর্বাধিক গুরুত্ব রয়েছে। হযরত আলী রাজি. বলেছেন- আমি সেই ব্যক্তির গোলাম যিনি আমাকে একটি শব্দ শিক্ষা দিয়েছেন। দুঃখের বিষয় যে, সাধারণত আজ ইসলামের এ মহান আদর্শের মূল্যায়ন করা হয় না, যার ফলে ক্রমশ: শিক্ষাব্যবস্থার অবনতি ঘটছে। কিন্তু আকাবিরগণ বিশেষত: বুযুর্গানে দেওবন্দের প্রতি নানুপুরী সাহেবের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল সুগভীর ও নজীরবিহীন। বিশেষভাবে আপন মুর্শিদ মুহাক্কিক আলেমে দ্বীন হযরত মুফতি আজিজুল হক সাহেব (মৃত্যু- ১৩৮০হি.) এর প্রতি ছিলেন তিনি গভীর অনুরাগী, আশেক এবং নিবেদিত প্রাণ। হযরত মুফতী সাহেব শুধু তাঁর পীরই ছিলেন না; বরং তাঁর প্রাণাধিক মাহবুবও ছিলেন। সদা-সর্বদা মুর্শিদের কথার উদ্ধৃতি দেওয়াকে গৌরবময় মনে করতেন।
একদা হযরত মুফতী সাহেবের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন- হযরত! আমি কিছুই জানি না, আপনার কাছে মুসলমান হতে এসেছি। অনেক বুযুর্গদের কাছে আসা-যাওয়া করেছি, কিন্তু অন্তরটা আপনার সাথেই বেশি লাগে, অন্য কোন দিকে তেমন যায় না। আরেক সময় তিনি যখন হযরত মুফতী সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছু দিনের জন্যে বাড়ি চলে গেলেন, তখন থেকে পুনরায় সাক্ষাত লাভ পর্যন্ত তিনি আপন মুর্শিদের মুহাব্বতে ছটপট করতে থাকেন। খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, লেখা-পড়া, স্ত্রী-পুত্র কিছুই যেন তাঁর ভাল লাগছিল না। এমন কি কেউ কেউ তাঁর মস্তিস্ক বিকৃতি হওয়ার ধারণা পোষণ করতে লাগলেন। পটিয়া পৌঁছে যখন প্রাণ প্রিয় মুর্শিদের সাক্ষাত লাভ করলেন, তখন দেখা গেল সবকিছু ঠিক আছে। মুর্শিদ ও মুরীদ একে অন্যেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কলিজা, মন-প্রাণ ও মস্তিস্ক ঠান্ডা করলেন। মোটকথা, মুফতি সাহেব ও নানুপুরী হুজুরের ইশ্ক ও মুহাব্বতের ঘটনা দ্বারা এ যুগে জিন্দা হয়ে উঠে হযরত শামস তিবরীযী এবং মাওলানা আরেফে রুমীর সে প্রেম-ভালবাসার স্মৃতি।
লেখক: হযরত মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী