মধ্যযুগীয়, পশ্চাদমুখী ইত্যাদি বলে আর চেঁচামেচি করবেন না
মাওলানা মোহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন
সম্প্রতি ইসলামী আদর্শ সম্বন্ধে বুদ্ধিজীবী নামক এক শ্রেণীর লোক একটু বেশী হারে বলতে শুরু করেছেন যে, এটি নাকি মধ্যযুগীয় ব্যাপার-স্যাপার, এটি নাকি অন্ধকার যুগের ব্যাপার-স্যাপার, এটি নাকি পশ্চাদমুখিতা। বিশেষত রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী আদর্শের কোন কিছু প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে কেউ কথা বললেই ঐ শ্রেণীর লোকেরা সমস্বরে চেঁচামেচি শুরু করে দেন যে, আমাদেরকে মধ্যযুগীয় আদর্শে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, আমাদেরকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যুগ এখন এগিয়ে চলেছে তখন আমাদেরকে পশ্চাতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন ধরুন কেউ রাষ্ট্রীয়ভাবে বে-হায়া বেলেল্লাপনার বিরুদ্ধে, উলঙ্গপনার বিরুদ্ধে, আইন করার আওয়াজ তুলল, ইসলামের পর্দা ব্যবস্থা কায়েম করার আওয়াজ তুলল, অমনি ঐ শ্রেণীর লোকেরা সমস্বরে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন যে, “আমাদেরকে মধ্যযুগীয় আদর্শে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যুগ এখন এগিয়ে চলেছে তখন আমাদেরকে পশ্চাতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। মোটামুটিভাবে তারা ইসলামী আদর্শকে এই তিনটি বিশেষণে বিভূষিত করে থাকেন- মধ্যযুগীয়, অন্ধকারযুগীয়, পশ্চাদমুখী।
জানি না এই শ্রেণীর লোকেরা ‘মধ্যযুগীয়’ বলে ঠিক কী বুঝাতে চান। আমরা তাদের কথিত অনেক কথারই তো মানে মতলব ঠিক মত বুঝি না। তারাও কোন দিন তা ভালভাবে খোলাসা করে বলেন না। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, ইত্যাদি কত কথারই মানে মতলব বা চৌহদ্দি সম্বন্ধে তারা স্পষ্ট করে কিছু বলেন না। যখন যেখানে যেভাবে সুবিধে তারা এই শব্দগুলো ব্যবহার করে স্বার্থ সিদ্ধি করেন। ‘মধ্যযুগীয়’ শব্দটার দশাও সে রকম। এর দ্বারা তারা যে ঠিক কী বোঝাতে চান তা আমরা পুরোপুরি স্পষ্টভাবে বুঝি না। তবে মোটামুটি এতটুকু বুঝি যে, মধ্যযুগীয় কথাটাকে একটা খারাপ ও নেতিবাচক অর্থেই তারা ব্যবহার করে থাকেন। তাই তারা প্রায়শই ‘মধ্যযুগীয় আদর্শ’ না বলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ কথাটা ব্যবহার করে থাকেন। ইসলামী আদর্শকে তারা মধ্যযুগীয় বর্বরতা আখ্যা দেন। ‘মধ্যযুগীয়’- এর সঙ্গে এই ‘বর্বরতা’- এর ব্যবহার তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানান দিয়ে থাকে। জানি না কেন তারা মধ্যযুগীয় কথাটাকে খারাপ অর্থে নিয়ে থাকেন। ইতিহাসে প্রাচীন ও আধুনিক কালের মধ্যবর্তী সময় মধ্যযুগ (গরফফষব ধমব) হিসাবে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। কেউ কেউ সীমানা নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছেন, রোমক সাম্রাজ্যের পতন (৫ম শতাব্দী) ও ইউরোপের অভ্যুদয় (১৫ শ শতাব্দী)- এর মধ্যবর্তী কাল হল মধ্যযুগ আবার কেউ কেউ বলেছেন মোটামুটি ভাবে ১১শ থেকে ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত যুগকে মধ্যযুগ বলা হয়, যে যুগে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারাদির ফলে মানুষের জীবন যাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। তখন সবেমাত্র ইউরোপে নতুন জ্ঞান সাধনার উন্মেষ হতে শুরু করেছে। আর পাদ্রীদের মনগড়া গবেষণাহীন মতামত গবেষকদের কাছে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে শুরু করেছে। এভাবে সৃষ্টি জগতের রহস্য যতই উদঘাটিত হতে থাকে, বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পাদ্রীদের মতবৈষম্য ততই প্রকট হতে থাকে। পাদ্রীগণ তখন শাসন শক্তি প্রয়োগ করে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের শায়েস্তা করতে থাকে। অবশেষে শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। দীর্ঘ দু’শ বৎসরের (১৬ ও ১৭ শতাব্দী) এ সংগ্রাম ইতিহাস পাঠকের নিকট ‘গির্জা বনাম রাষ্ট্রের সংগ্রাম’ নামে পরিচিত। স্মরণ করা যেতে পারে যে, প্রকৃত ইলমে ওহীর সঙ্গে (যার উপর ইসলাম পন্থীরা প্রতিষ্ঠিত তার সঙ্গে) বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার (যদি তা সঠিক হয়) ও উদঘাটিত সৃষ্টির রহস্যের তাত্ত্বিকভাবে কোন সংঘাত বা বৈপরীত্য নেই, থাকতে পারে না। আরও স্মরণ করা যেতে পারে যে, পাদ্রীগণ সঠিক ইলমে ওহীর উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, তারা মনগড়া কিছু মতাদর্শকে ধর্মের নামে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে সম্বল করে অতি সুখে দিন গুজরান করেছিল। এরই ফলে বিজ্ঞানের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এটাকেই ইউরোপীয়রা ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সংঘাতরূপে অভিহিত করে আর তাদের এদেশীয় এজেন্টরা তা তড়িৎ বেগে আমদানি করে ফেলে। সম্ভবত এখান থেকেই বুদ্ধিজীবীগণ মধ্যযুগীয় বলে ইসলামপন্থীদেরকে বিজ্ঞান বিরোধী রূপে অভিহিত করতে চান। কিন্তু এটা পাদ্রীদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হতে পারে ইসলামপন্থী আলেম মৌলভীদের ব্যাপারে নয়। বরং ইসলামপন্থীদের মতাদর্শ ও অবস্থান সেই মধ্যযুগেও যেমন বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘাতবিহীন ছিল, এখনও তেমন রয়েছে। অতএব ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে মধ্যযুগীয় কথাটার প্রয়োগ হবে সত্যতার অপলাপ। যারা সত্যিকার অর্থে মধ্যযুগীয় তাদের প্রগতিশীল আর যারা তেমন নয় তাদেরকে মধ্যযুগীয় আখ্যায়িত করা হবে উল্টা কারবার। ইসলাম ও ইসলামপন্থীদেরকে মধ্যযুগীয় আখ্যায়িত করে বুদ্ধিজীবীগণ এই সত্যের অপলাপ এবং উল্টো কারবারই করে চলেছেন।
কিন্তু বুদ্ধিজীবীগণ মধ্যযুগীয় বলে বিজ্ঞানবিরোধীই যে বোঝাতে চান তা-ও তো স্পষ্ট নয়। কারণ তারা মধ্যযুগীয় কথাটার সঙ্গে বর্বরতার কথাটা প্রয়োগ করে থাকেন। বিজ্ঞানবিরোধী হওয়া আর বর্বর হওয়া আদৌ সমান্তরাল নয়। সভ্যতা, শিষ্টাচার, মনুষ্যত্ব- এগুলোর সঙ্গে বিজ্ঞানের সরাসরি সম্পর্ক কোথায়? বিজ্ঞানের সরাসরি সম্পর্ক তো বস্তুর সঙ্গে, বস্তুবিষয়ক আবিষ্কারের সঙ্গে, আর সভ্যতা, শিষ্টাচার, মনুষ্যত্ব- এগুলোর সম্পর্ক হচ্ছে মানবীয় আচার-ব্যবহার ও মানবীয় চরিত্রের সঙ্গে। অতএব বিজ্ঞানবিরোধী আর বর্বর কথাটা আদৌ সমার্থবোধক নয়। এমতাবস্থায় মধ্যযুগীয় বর্বর বলে বিজ্ঞানবিরোধী বোঝাতে চেয়ে কি বুদ্ধিজীবীরা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন?
‘বর্বরতা’ কথার প্রয়োগ সম্বন্ধে সামান্য আর একটু বলতে চাই। বর্বরতা অর্থ অসভ্যতা, অশিষ্টতা, পশুত্বব্যঞ্জক আচরণ ইত্যাদি। যারা সামান্য ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন তারা জানেন ইসলাম একটা বর্বর জাতিকে কেমন সভ্য ও শিষ্ট জাতিতে পরিণত করেছিল। ইসলাম অসভ্যতা, অশিষ্টতা ও পশুত্বব্যঞ্জক আচরণ ও রীতিনীতি তথা বর্বরতা প্রতিরোধে যতটা সোচ্চার ও যতœবান, পৃথিবীর আর কোন ধর্ম বা মতাদর্শ ততটা সোচ্চার ও যতœবান নয়। অথচ এটা ইসলামী আদর্শকেই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ বলেছেন বর্বরতা, আর প্রকৃত বর্বরতাকে তারা আখ্যায়িত করছেন সভ্যতা, প্রগতিশীলতা ইত্যাদি। এমন উল্টো ব্যাখ্যা প্রদান মস্তিষ্ক বিকৃতির পরিচয় কিনা তা তাদের ভেবে দেখা উচিৎ। রাস্তা-ঘাটে, ক্লাবে, পার্কে নারীদের শ্লীলতাহানি ও ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে তাদের সতীত্ব হরণ বর্বরতা, নাকি এগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বর্বরতা তা তাদের সত্যিকার অর্থে ভেবে দেখা উচিৎ। তারা বর্বরতার কথাটার অর্থ ও বর্বরতা প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা সম্বন্ধে মোটেই অবগত নন, তারা ইতিহাস সম্বন্ধে এতটাই অজ্ঞ- তাদের সম্বন্ধে এমনটা ধারণা আমরা রাখি না। আসলে তারা জেনে বুঝেই মিথ্যাচার করেন, জেনে বুঝেই উল্টো কথা বলেন, উল্টো ব্যাখ্যা দেন। তারা বোঝেন উল্টো, বলেনও উল্টো, করেনও উল্টো। এই শ্রেণীর লোকদেরকে তাই উল্টো করেই হাশরের ময়দানে উঠানো হবে, উল্টো করেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যেমন আচরণ তেমনি ফল। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
ﭽ ﰂ ﰃ ﰄ ﰅ ﰆ ﰇ ﰈ ﰉ ﰊ ﭼ
অর্থাৎ, যে দিন তাদেরকে মুখ হিঁচড়ে (অধোমুখী করে) টেনে নেওয়া হবে জাহান্নামে। (বলা হবে) আগুনের স্পর্শ আস্বাদন কর। [সূরা ক্বামার: ৪৮]
এখানে আরও উল্লেখ করতে হয় যে, মধ্যযুগীয় কথাটার দ্বিতীয় ব্যাখ্যা অনুসারে বিজ্ঞানের উন্নতি বিচারে এই যুগটা তেমন অগ্রসর বিবেচিত না হলেও আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিচারে এ যুগটি অনগ্রসর নয়; বরং সবচেয়ে অগ্রসর। এই মধ্যবর্তী যুগের প্রথম ভাগেই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আদর্শ, সবচেয়ে নির্ভুল আদর্শ তথা ইসলামী আদর্শ বিকশিত, বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব আদর্শিক উৎকর্ষ লাভের প্রশ্নে মধ্যযুগীয় আদর্শেই ফিরে যেতে হবে। আদর্শের আলোচনা প্রসঙ্গে (দ্বিতীয় অর্থে) মধ্যযুগীয় কথাটাকে খারাপ ও নেতিবাচক অর্থে নেওয়ার অবকাশ নেই। বে-হায়া বেলেল্লাপনা ও উলঙ্গপনার পক্ষ অবলম্বনকারীগণ হবেন আদিযুগীয়, তথা তাদের স্বীকৃত ভাষায় বর্বর যুগীয়। এমন কি তারা হতে চাইবেন? নিশ্চয়ই না।
যারা ইসলামী আদর্শকে অন্ধকার যুগের ব্যাপার স্যাপার বলে আখ্যায়িত করে থাকেন তাদের অবগতির জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অন্ধকার যুগ হল ইসলাম পূর্ব জাহেলী যুগ। ইসলাম এই জাহেলী যুগের কুফ্র, র্শিক, জুলুম ও নানাবিধ পাপাচারের অন্ধকার দূর করে আলোর সূচনা করেছিল। ইসলাম অন্ধকার যুগকে আলোর যুগে পরিণত করেছিল। কুরআন সুন্নাহর আদর্শ হল নূর তথা আলো। কুরআনে কারীমের এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে।
ﭽ ﭽ ﭾ ﭿ ﮀ ﮁ ﮂ ﮃ ﭼ
অর্থাৎ, তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহ পাকের কাছ থেকে নূর অর্থাৎ সুস্পষ্ট কিতাব। [সূরা মায়িদা: ১৫]
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
ﭽ ﯧ ﯨ ﯩ ﯪ ﭼ
অর্থাৎ, তোমাদের কাছে আমি পাঠিয়েছি সুস্পষ্ট নূর। [সূরা নিছা: ১৭৪]
অতএব কুরআন সুন্নাহর যুগ অন্ধকার যুগ নয়; বরং আলোকিত যুগ। ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগ হল সর্ববাদিসম্মত অন্ধকার যুগ। ইসলামী আদর্শের কথা শুনলে যারা অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা বলে চেঁচামেচি করেন, তারা নিজেদের জ্ঞানান্ধতার পরিচয় দেন। আসলে তারাই রয়েছেন অন্ধকারে। আলেম উলামা ও মোল্লা মৌলভীগণ সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান আর তাদের বিরুদ্ধবাদী এই বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে নিয়ে যান অন্ধকারের দিকে।
কুরআনে কারীমে কত সুন্দর করে বলা হয়েছে,
ﭽ ﭑ ﭒ ﭓ ﭔ ﭕ ﭖ ﭗ ﭘ ﭙﭚ ﭛ ﭜ ﭝ ﭞ ﭟ ﭠ ﭡ ﭢ ﭣﭤ ﭥ ﭦ ﭧﭨ ﭩ ﭪ ﭫﭼ
অর্থাৎ, আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে বহুবিধ অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর যারা কাফের তাদের অভিভাবক হল তাগুত, এরা তাদেরকে আলো থেকে বের করে বহুবিধ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। তারাই জাহান্নাম বাসী তারা সেখানে স্থায়ী হবে। [সূরা বাকারা: ২৫৭]
আল্লাহ বলেছেন, তিনি অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আলেম উলামা ও মোল্লা মৌলভীগণও সে মোতাবেক সমাজকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। এর বিপরীত লোকেরা করে এর বিপরীত। তারা সমাজকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। অথচ তাদের দাবী সম্পূর্ণ উল্টো। তথাকথিত এই বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে তাই বলছি, উল্টা সমঝিলি রে রাম ! বোঝেও উল্টো, বলেও উল্টো, করেও উল্টো। তাদেরকে তাই উল্টো করেই হাশরের ময়দানে উঠানো হবে, উল্টো করেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তথাকথিত বুদ্ধিজীবীগণ ইসলামী আদর্শের বিরোধিতা করেও আদি অন্ধকারেই ফিরে যাওয়ার প্রবক্তা সাজছেন। বে-হায়া বেলেল্লাপনা ও উলঙ্গপনার পক্ষ অবলম্বন করে যেমন তারা আদিযুগীয় সাব্যস্ত হচ্ছেন তেমনি ইসলামের অন্যান্য আদর্শের বিরোধিতা করেও তারা আদিযুগীয় সাব্যস্ত হচ্ছেন।
আর ইসলাম পশ্চাদমুখী কিনা- এ প্রসঙ্গে খুব বেশি কিছু বলার প্রয়োজন থাকেনি। কারণ কুফর, র্শিক ও পাপাচারের আদি অন্ধকারের পর এসেছে ইসলামের আলো। ইসলামের দ্বারা সাধিত হয়েছে আলোকিত আদর্শ ও উৎকর্ষ। অতএব যারা কুফ্র, শ্র্কি ও পাপাচারের আদি অন্ধকার পথে ফিরে যায়, তারাই প্রকৃতপক্ষে পশ্চাদমুখী। যারা ইসলামী আদর্শের প্রবক্তা, তারা পশ্চাদমুখী হতে পারে না, তারা প্রগতিশীল, কারণ তারা অন্ধকার পরবর্তী আলোর পথের যাত্রী।
ইসলামের আলো বিকশিত হওয়ার পরেও কালক্রমে বহুমুখী আধুনিক অন্ধকার সমাজকে গ্রাস করেছে। বুদ্ধিজীবীগণ বেশির থেকে বেশি এই দাবি করতে পারেন যে, তারা আদি অন্ধকার নয় বরং পরবর্তী এই সব আধুনিক অন্ধকারের প্রবক্তা। কিন্তু এ দাবী করে তারা আদিযুগীয় হওয়া থেকে নিষ্কৃতি পাবেন না। কারণ আধুনিক কালে প্রচলিত সব পাপাচারই আদিকালের পাপাচারেরই নতুন সংস্করণ বরং কোন কোনটার হুবহু পুরাতন সংস্করণই চলছে। জুলুম, সম্পত্তি আত্মসাৎ, চুরি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, বে-হায়া বেলেল্লাপনা, বাদ্য বাজনা ইত্যাদির অনেক নতুন সংস্করণ ও নতুন কলাকৌশল চালু হয়েছে। আবার ডাকাতি, ছিনতাই, যেনা, বেপর্দেগী, ছেলে মেয়েদের ঢলাঢলি, নাচ, গান- এসবের পুরাতন সংস্করণই হুবহু চলছে। এভাবে সব পাপই কোন না কোনভাবে হলেও পুরাতন পাপেরই পুনরাবৃত্তি। এমনকি অধুনা ইসলামপন্থী দ্বীনদার মুসলমান ও আলেম উলামাকে যেসব গালিগালাজ ও কটূক্তি করা হয়ে থাকে তা-ও কোন না কোনভাবে পুরাতন যুগের গালিগালাজ ও কটূক্তিরই পুনরাবৃত্তি। সেগুলো সবই পুরনো রেকর্ডের ভাঙ্গা সুর।
সেই আদি যুগে হযরত শুহাইব আ. এর সম্প্রদায় হযরত শুআইব আ. কে বলত,
ﭽ ﭶ ﭷ ﭸ ﭹ ﭺ ﭻ ﭼ ﭽ ﭾ ﭼ
অর্থাৎ, আমরা তোমার কথাবার্তার সিংহভাগই বুঝি না, তুমি তো আমাদের মধ্যে দুর্বল। [সূরা হুদ: ৯১]
হযরত হূদ আ. এর সম্প্রদায় হযরত হূদ আ. কে বলত,
ﭽ ﰅ ﰆ ﰇ ﰈ ﰉ ﰊ ﰋ ﰌ ﰍ ﭼ
অর্থাৎ, তুমি তো আমাদের কাছে (তোমার বক্তব্যের স্বপক্ষে) কোন স্পষ্ট দলীল উপস্থাপন করতে পারলে না। আমরা তোমার কথায় আমাদের দেবদেবীদের (অর্থাৎ আমাদের আদর্শ) ছাড়তে পারি না। [সূরা হূদ: ৫৩]
লক্ষ করুন এ কথাগুলোকেই এখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হচ্ছে যে, আমরা হুজুরদের কথা বুঝি না, তাদের কথায় কোন যৌক্তিকতা নেই, সমাজে তাদের কোন প্রতিষ্ঠা নেই, তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা সমাজের পরগাছা, হুজুরদের কথায় আমরা আমাদের আদর্শ ত্যাগ করতে পারি না ইত্যাদি।
বস্তুত পরবর্তী সর্বযুগের পাপীরাই পূর্ববর্তী পাপীদের অনুসরণ করে থাকে। সর্বযুগের পাপীদেরই পাপের মৌলিক ধরণ এক। কুরআনে কারীমের এক আয়াতে বলা হয়েছে,
ﭽ ﮔ ﮕ ﮖ ﮗ ﮘ ﮙ ﭼ
অর্থাৎ, বরং তারা বলে যেমন তাদের পূর্ববর্তীরা বলত। [সূরা মুমিনূনঃ ৮১]
এক হাদীসে নবী করীম সা. কথাটিকে এভাবে বলেছেন,
لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ.
অর্থাৎ, তোমরা (পাপের ধরনের ক্ষেত্রে) তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবে বিঘতে বিঘতে, হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি কোন গুইসাপের গর্তে ঢুকে থাকে তোমরাও তাতে ঢুকবে। [বুখারী: ৩৪৫৬; মুসলিম: ২৬৬৯]
তাই ইসলামপন্থীদের তেমন চিন্তার কিছু নেই। তাদেরকে যা কিছু এখন শুনতে হচ্ছে তা নতুন কিছু নয়, নিত্য চলে আসা এক ধারাবাহিকতা মাত্র। কিšু‘ ইসলাম-বিদ্বেষী বুদ্ধিজীবীদের জিজ্ঞাসা করি প্রগতিশীলতার দাবিদার হয়ে আর কতদিন এই পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটবেন, আর কতকাল এই পুরানো রেকর্ডের ভাঙ্গা সুর বাজাবেন? এই পুরাতন চেঁচামেচি বন্ধ করুন। এই একঘেয়েমিতে আমরা যে বড্ড বিরক্তি বোধ করি। বারবার পুরানো কথার খ-ন করতে আমাদের যে ত্যক্ততা ধরে গেছে। অবশ্য আমরা ত্যক্ত-বিরক্ত হই জানলে আপনারা আবার সেটাকে সাফল্য মনে করে আরো উৎসাহিত হয়ে ওঠেন কিনা তাই বলছি, আমরা আপনাদের এসব কথায় বড় আনন্দ পাই এই ভেবে যে, আমাদের মহান পূর্বসূরিগণও এরূপ কথা বার্তা শুনেছেন, শুনে আমাদের জন্য তারা সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি উৎরানোর আদর্শ রেখে গেছেন। আমরা যে আমাদের মহান পূর্বসূরিদের মিছিলে শামিল হতে পারাতে আনন্দ বোধ করি।
লেখক: শাইখুল হাদীস, জামিয়া ইসলামিয়া তাঁতীবাজার ঢাকা