সালাহুদ্দীন আল-আইয়্যূবী হাসতেন কম। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, “আপনি এতো কম হাসেন কেন? মাঝেমাঝে দেখি মনমরা হয়ে থাকেন।” সালাহুদ্দীন জবাব দেন, “আল-আকসা ক্রুসেডারদের দখলে, এটা জানার পর আমার মুখে হাসি ফুটে কিভাবে? আমি হাসবো কিভাবে, বলো?”
মুসলিম বিশ্বের অবস্থা ছিলো তখন চরম অস্থিতিশীল। একেক জায়গা থেকে একেকজন খিলাফত দাবী করছে। মুসলিমরা বুঝে উঠতে পারছে না কার কাছে বায়াত দিবে। একে তো আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তারউপর ক্রুসেডারদের আক্রমণ। কয়েকবছর আগে ক্রুসেডাররা জেরুজালেমে ঢুকে সত্তর হাজার মুসলিমকে হত্যা করে মসজিদুল আকসা দখল করেছে। মুসলমানদের রক্তের বন্যায় সেদিন উটের খুর ডুবে গিয়েছিলো। সবমিলিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজমান।
ঠিক এমন এক সময় সিথ খাতুন স্বপ্নে দেখেন তাঁর গর্ভের মধ্যে একটা তরবারি। সন্তানসম্ভবা সিথ খাতুন বুঝতে পারলেন, তিনি যাকে গর্ভে ধারণ করেছেন সে বড় হয়ে কিছু একটা হবে। জন্মের পর ছেলের নাম রাখলেন সালাহুদ্দীন।
মুসলমানদের চরম সংকটকালে সালাহুদ্দীনের জন্ম হয়৷ মুসলিমরা না ঘর সামলাবে না বাহির। পরাজয়ের গ্লানি, পারস্পরিক মতবিরোধে জর্জরিত মুসলিম উম্মাহ তখন কিয়ামতের দিনক্ষণ গণনা করছে। মুসলিমরা অনেকেই আশা হারিয়ে ফেলেছিলো।
মুসলিমদের বৃহৎ অংশ যখন হতাশার ব্যধিতে আক্রান্ত তখন সালাহুদ্দীন আল-আকসার কথা বলতেন। প্রায় প্রতিদিন কারো সাথে তিনি আল-আকসা, জেরুজালেম নিয়ে কথা বলতেন। দূর-দূরান্তের মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে আকসা পুনরুদ্ধারের চিঠি লিখতেন।
এসবের জন্য অনেকেই তাঁকে ‘পাগল’ ভাবতো। তারা বলতো, “দেখো, আমরা নিজের ঘরের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত, আবার ঐদিক থেকে ক্রুসেডাররা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর তুমি কিনা আকসা নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছো!”
হতাশাগ্রস্ত মানুষের মন্তব্য সালাহুদ্দীন খুব একটা কানে নিতেন না। তিনি তাঁর কাজ করে যেতেন। আল-আকসার প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা ছিলো, আকসাকে তিনি যেভাবে লালন করতেন সেই সম্পর্কে একজন বলেন, “আকসার প্রতি সালাহুদ্দীনের হৃদয়ে যে ভালোবাসা আছে, সেটা যদি একটা পাহাড়ের উপর রাখা হয় তাহলে পাহাড়টি গলে যাবে।”
আল-আকসা পুনরুদ্ধারের জন্য সালাহুদ্দীন যখন যাত্রা শুরু করেন, তখন কিছু জ্যোতিষি তাঁকে বললো, “দেখুন, আপনি যদি জেরুজালেম যান তাহলে আপনি আপনার এক চোখ হারাবেন।”
জ্যোতিষি চাচ্ছিলো তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে। সালাহুদ্দীন আইয়্যূবী উল্টো তাকে বলেন, “তুমি আমাকে এক চোখ হারানোর ভয় দেখাচ্ছো? ওয়াল্লাহী! আল-আকসা পুনরুদ্ধার করার জন্য যদি দুই চোখ হারিয়ে অন্ধ হতে হয়, তবুও আমি আল-আকসা পুনরুদ্ধার করবো।”
আল্লাহর উপর ভরসা, আকসার প্রতি ভালোবাসা, আর ক্রুসেডারদের মোকাবিলা করার অভিনব প্ল্যান নিয়ে সালাহুদ্দীন রওয়ানা দেন আকসা পুনরুদ্ধারে।
ইতিহাস নির্ধারণী সেই সিরিজ যুদ্ধে মুসলিমরা আকসা ফিরে পায়। দীর্ঘ ৮৮ বছর আল-আকসায় কোনো আজান-নামাজ হয়নি। আকসা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব মনে করে মুসলিমরা যখন হাত গুটানো শুরু করেছিলো, তখন আল্লাহ সালাহুদ্দীনের মাধ্যমে মুসলিমদের ঘুম ভাঙ্গান। রাহিমাহুল্লাহ।
পৃথিবীর একেক প্রান্তে এখন একেকটা ‘আকসা’। সবগুলো আকসা যেন সমস্বরে ডাকছে-
“আমি অনুক্ষণ তোমার আসার অপেক্ষাতেই রই
তোমার বুকের পাঁজরে লুকানো সালাহুদ্দীন কই?”