আমাদের এলাকায় বিগত দুই/তিন বছর যাবত মাইকিং করে মহিলাদের জন্য বিভিন্ন স্থানে মহিলা সম্মেলন-এর আয়োজন করা হয়। উক্ত সম্মেলনে কখনও কোনো পুরুষ এবং মহিলা বক্তা ওয়াজ করেন আবার কখনও শুধু মহিলা বক্তা ওয়াজ করেন। মহিলা বক্তাও পুরুষ বক্তাদের মত সুর দিয়ে মাইক ব্যবহার করে এমনভাবে ওয়াজ করেন যে, তার সুরেলা কন্ঠস্বর সম্মেলনের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। যা পথচারী পুরুষ এবং আশপাশে অবস্থানরত পুরুষগণ অনায়াসেই শুনতে পায়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের অবস্থাও উদ্ভট। সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলা বেপর্দা অবস্থায় সম্মেলনে আসা যাওয়া করে। সম্মেলন শেষে সভাস্থল ত্যাগের সময় বেপর্দা নারীদের জটলা বেধে রাস্তা দিয়ে চলা -দিনের আলোতে সকলেরই দৃষ্টিগোচর হয়। এতে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
এধরনের সম্মেলনের আয়োজকদের নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বুখারী শরীফের কিতাবুল ইলমের নিম্নে বর্ণিত বাবগুলোর হাদীস দ্বারা উক্ত সম্মেলনের পক্ষে দলীল পেশ করে থাকেন।
১. باب تعليم الرجل أمته وأهله
২. باب عظة الإمام النساء وتعليمهن
৩. باب هل يجعل للنساء يوم على حدة في العلم
অতএব, মুফতী সাহেবের নিকট আমার জানার বিষয় হল:
ক. উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে কোন মহিলা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মাইক ব্যবহার করে সুরেলা কন্ঠে ওয়াজ-নসীহত করার হুকুম কী?
খ. বর্ণিত পদ্ধতিতে দিনের বেলায় বেপর্দা অবস্থায় মহিলাদের জন্য এ ধরনের ওয়াজ মাহফিলে অংশগ্রহণের হুকুম কী?
গ. এ ধরনের মহিলা সম্মেলন আয়োজন করার হুকুম কী?
ঘ. এ ধরনের মহিলা সম্মেলনের পক্ষে উক্ত বাবগুলো দ্বারা দলীল পেশ করা যাবে কি?
কুরআন সুন্নাহর আলোকে এ বিষয়গুলোর শরয়ী সমাধান বিস্তারিত দলীল প্রমাণসহ জানালে এলাকাবাসী চির কৃতজ্ঞ হবে।
ওয়ায নসীহত, দ্বীনী আলোচনা নিঃসন্দেহে মুমিনদের জন্য উপকারী। পুরুষের মত মহিলাদের মাঝেও দ্বীনী তালীম-তরবিয়ত, ওয়ায-নসীহত শরীয়তসম্মত পন্থায় ব্যাপকভাবে হওয়া দরকার। বিশেষত বর্তমানে ফেতনা -ফাসাদের ব্যাপকতার যুগে তাদের মাঝে ওয়ায-নসীহত ও তালীম-তরবিয়তের প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্নের বক্তব্য অনুযায়ী মহিলাদেরকে প্রকাশ্যে মাঠে ময়দানে ডেকে এনে এভাবে সম্মেলন করা এবং মহিলা বক্তা কর্তৃক সেখানে মাইকে আলোচনা করার প্রচলিত পন্থাটি শরীয়তসম্মত নয় । এ পদ্ধতির সম্মেলন বা ওয়ায মাহফিল বর্জনীয়। কেননা,
(ক) প্রচলিত পদ্ধতির উক্ত মহিলা সম্মেলন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তালীম-তরবিয়ত সাহাবা- তাবেয়ীনের অনুসৃত তরীকা পরিপন্থী। দ্বীন-শেখা শেখানো, ওয়ায-নসীহতের পথ ও পন্থা শরীয়ত নির্দেশিত উপায়ে হওয়া আবশ্যক। শরীয়ত সমর্থন করে না এমন সব পন্থা বর্জন করা জরুরী।
নবীযুগের নারীরা পরবর্তী যে কোনো যুগের নারী অপেক্ষা দ্বীন শেখার প্রতি অধিক আগ্রহী ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র মুখ থেকে ওয়ায নসীহত শোনার প্রবল আকাঙ্ক্ষা রাখতেন। তিনি তাদেরকে যে পন্থায় ওয়ায নসীহত করেছেন মূলত সেটাই আমাদের অনুসরণীয়। সে পদ্ধতি কী ছিল লক্ষ্য করুন।
সহীহ বুখারী ও সহীহ ইবনে হিব্বানে বর্ণিত হয়েছে, একবার কিছু সংখ্যক নারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার মজলিসে পুরুষদের সাথে বসতে পারি না। আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করুন যাতে সেদিনটিতে আমরা আপনার নিকট আসতে পারি। তিনি বললেন موعدكن بيت فلانة অর্থাৎ নির্ধারিত দিন অমুক মহিলার ঘরে জমায়েত হও। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাদেরকে ওয়ায-নসীহত করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৪১
লক্ষ করুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের ওয়ায নসীহত করার জন্য পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে কেমন ঘরোয়া পরিবেশ ও স্থান নির্বাচন করেছেন। তাদের আবদারের প্রেক্ষিতে প্রকাশ্য স্থান যেমন মসজিদে নববী, ঈদগাহ বা ঘরের আঙ্গীনার কথা না বলে সরাসরি বলে দিলেন موعدكن بيت فلانة অমুক মহিলার গৃহে অবস্থান কর। মূলত তাঁর এ নির্দেশ মহিলাদের গৃহাভ্যন্তরে অবস্থানের যে কুরআনী নির্দেশনা রয়েছে তারই অংশ।
(খ) প্রশ্নের বর্ণনা অনুযায়ী উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নারী শ্রোতাদের থেকে ব্যাপকভাবে পর্দার বিধান লংঘন হয়। যা নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু তারা যদি যথাযথভাবে পর্দা মেনেও উক্ত সম্মেলনে আসার পাবন্দী করে নেয় তথাপি এ ধারার মহিলা সম্মেলন গোড়া থেকেই শরীয়তের রুচি প্রকৃতি ও স্বভাব বিরুদ্ধ। শরীয়তের স্বভাব চাহিদা হল, মহিলাদের ইবাদত বন্দেগী থেকে শুরু করে তাদের সকল কর্মকাÐ পুরুষদের থেকে আলাদা ও অতি গোপনীয় হবে। পুরুষের জন্য যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে এসে জামাতের সাথে আদায় করা শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ হুকুম সেখানে তাদেরকে গৃহাভ্যন্তরে নামায আদায় করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। মসজিদে নববীতে যেখানে এক রাকাত নামায এক হাজার রাকাত সমান, এক বর্ণনামতে পঞ্চাশ হাজার রাকাত সমান, এর সাথে আবার আল্লাহর রাসূলের মত ইমামের পেছনে নামায পড়ার সৌভাগ্য তো রয়েছেই। তা সত্বেও সে সময় নারী সাহাবীদেরকে তাদের গৃহাভ্যন্তরের সর্বাধিক নির্জন স্থানে নামায পড়াকে উত্তম বলা হয়েছে।
এ কথা ঠিক যে, প্রথম দিকে কোনো কোনো মহিলা প্রতিনিয়ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি নাযিলকৃত নতুন নতুন ওহী ও বিধি বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য,পাশাপাশি প্রিয় নবীর মত ইমামের পেছনে নামায পড়ার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণে মসজিদে নববীর জামাতে অংশগ্রহণ করত। তিনি তাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন না। তবে তার জন্য বেশ কিছু শর্ত ছিল। যেমন,
১. পূর্ণ পর্দার সাথে আসতে হবে। ২. সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারবে না। ৩. সাজসজ্জা পরিত্যাগ করতে হবে। ৪. রাতে আসবে, দিনে আসবে না। ৫. মহিলারা সবার পরে আসবে এবং নামায শেষে পুরুষদের আগে বের হয়ে যাবে।
৬. কোনো অবস্থায়ই পুরুষদের সাথে মেলা-মেশার আশঙ্কা না থাকতে হবে।
লক্ষ করুন, এত পাবন্দী এমন যুগের নারীদের ব্যাপারে ছিল যাকে ইসলামের সোনালী যুগ বলা হয়। যাদের মাঝে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল বিদ্যমান ছিলেন। অতপর তাঁর ইন্তেকালের পর সামাজিক পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনের কারণে সাহাবায়ে কেরাম মহিলাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করে দেন এবং মহিলারাও মসজিদে আসা বন্ধ করে দেয়। উম্মাহাতুল মুমিনীন এবং অন্যান্য মহিলা সাহাবীদের তাকওয়া তহারাত, খোদাভীতি যা প্রবাদতুল্য, এবং পরবর্তীযুগের নারীদের জন্য যারা হলেন আদর্শ তাঁদের ব্যাপারে যদি এমন নিষেধাজ্ঞা হয় তাহলে এমন ফেতনা-ফাসাদের ব্যাপকতার যুগে প্রকাশ্যে দিবালোকে বেপর্দার সাথে দূর দুরান্ত থেকে মহিলাদের উক্ত সম্মেলনে যাতায়াত কীভাবে অনুমোদিত হতে পারে?
(গ) উক্ত মহিলা সম্মেলনে মহিলা বক্তা কর্তৃক মাইকে আলোচনা করা, সুরেলা কন্ঠে বয়ান করা,যার আওয়াজ সভাস্থলের গণ্ডি পার হয়ে কেবল আশপাশের পুরুষগণই নয়; বরং দূর দূরান্তের লোকদের কাছেও পৌঁছে যায়, তা শরীয়তের নির্দেশনার যে সুস্পষ্ট সীমালংঘন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নারীর প্রতি শরীয়তের বিধান ও চাহিদা হল, তার কন্ঠস্বর যেন প্রয়োজন ছাড়া পরপুরুষ শুনতে না পায়। এ বিধান কেবল সাধারণ ক্ষেত্রেই নয়; বরং ইবাদত বন্দেগী ও আমলের ক্ষেত্রেও তা পূর্ণমাত্রায় লক্ষ রাখা হয়েছে। যেমন,
১. মুআযযিনের এত অধিক মর্যাদা থাকা সত্বেও নারী কন্ঠস্বর যেন বিনা প্রয়োজনে পরপুরুষ শুনতে না পায় এজন্য তাদের উপর আযানের বিধান দেয়া হয়নি।
২. উচ্চ আওয়াজ বিশিষ্ট ফরয নামাযের কেরাত তাদের জন্য নিম্ন আওয়াজে পড়ার বিধান রয়েছে।
৩. নামাযে ইমামের কোনো ভুল ত্রæটি হলে তা অবগত করানোর জন্য পুরুষ মুক্তাদীদেরকে সুবহানাল্লাহ বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে একই বিষয়ে নারীদেরকে তাসফীক অর্থাৎ এক হাতের পিঠ অন্য হাতের তালুতে মেরে শব্দ করতে বলা হয়েছে। যেন পুরুষরা আওয়াজকারী সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বুঝতে না পারে।
৪. হজ্বের তালবিয়া পুরুষগণ উচ্চ আওয়াজে পড়বে। কিন্তু মহিলারা পড়বে নিম্ন আওয়াজে। এধরনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পার্থক্য বিদ্যমান।
হাঁ, প্রয়োজনে পরপুরুষের সাথে পর্দার আড়ালে থেকে টুকটাক দরকারী কথা বলা নিষেধ নয়। তবে এক্ষেত্রেও কোমলতা, নম্রতা পরিহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হল, কন্ঠস্বরের কোমলতা পরিহারের নির্দেশ সরাসরি নবীযুগের নারীদেরকে দেয়া হয়েছে। এখন কথা হল, তাদের ব্যাপারেই যদি এমন নির্দেশ হয়ে থাকে তাহলে এ যুগের মহিলা বক্তাদের মাইকে আলোচনা করা এবং সুরেলা কন্ঠ দেয়া কতটা শরীয়ত বিরোধী কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোটকথা প্রশ্নোক্ত মহিলা সম্মেলনে শরীয়ত নিষিদ্ধ একাধিক কর্মকাণ্ড ও আপত্তি বিদ্যমান, তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করা থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরত থাকা আবশ্যক।
আর প্রশ্নে যেসব হাদীসের উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে উক্ত মহিলা সম্মেলনের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। উক্ত অধ্যায়ের হাদীসগুলো দেখলেই তা সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
যেমন প্রথম হাদীসটি লক্ষ করুন, এ হাদীসের মূল বক্তব্য হল পুরুষগণ নিজেরা পরিবার পরিজনকে সুন্দর আদব আখলাক, তালীম তরবিয়ত শিক্ষা দিবে। এজন্য সে দ্বিগুন সওয়াবের অধিকারী হবে।
এ হাদীসে তো নিজ পরিবার পরিজনের শিক্ষা দীক্ষা, তালীম তরবিয়তের ব্যাপারে পুরুষের দায়িত্ব বুঝানো হয়েছে। এবং তাদের শিক্ষা দীক্ষা ঘরোয়া পরিবেশে হবে তাও স্পষ্ট।
দ্বিতীয় হাদীসের সারকথা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মহিলা সাহাবীদের যখন ঈদগাহে যাওয়ার অনুমতি ছিল তখন একবার ঈদের নামায শেষে মহিলাদেরকে ওয়ায নসীহত করেছিলেন। এ হাদীস দ্বারাও উক্ত সম্মেলনের পক্ষে প্রমান পেশ করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা তাদেরকে তো ঈদগাহে ওয়ায নসীহতের জন্য ডাকা হয়নি। তারা তো সেখানে ঈদের নামাযের জন্য এসেছিলেন।
আর তৃতীয় হাদীসের আলোচনা তো প্রথমেই করা হয়েছে যা দ্বারা এ সম্মেলনের বিপরীতটাই প্রমাণিত হয়।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দ্বীনের জরুরী ইলম শিক্ষা করা নারীদের উপরও ফরয। তাদেরকে সঠিক ঈমান-আকীদা শিক্ষা দেয়া, তালীম-তরবিয়ত করা, ওয়ায-নসীহত শোনানো খুবই দরকারি। তবে এর পদ্ধতি হতে হবে অবশ্যই শরীয়তসম্মত। আর এর অনুসৃত পদ্ধতি তো তা-ই যা হাদীস শরীফে এসেছে। অর্থাৎ ঘরের পুরুষরা দ্বীন শিখে তাদের নারীদেরকে শেখাবে। এতে প্রত্যেক ঘরেই দ্বীনী তালীমের চর্চা হবে এবং ঘরে ঘরে দ্বীনী পরিবেশ কায়েম হবে। পুরুষদের কর্মব্যস্ততার কারণে যদি অধিক সময় না পায় তবে তাদের থেকে নারীরা শিখে ঘরের মেয়েদেরকে অনুরূপ আশপাশের মেয়েদেরকে সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন মাজীদ শেখাবে, প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসায়েল শেখাবে, হক্কানী উলামায়ে কেরামের রচিত কিতাব থেকে ওয়ায-নসীহত শুনাবে। মাঝে মাঝে হক্কানী আলেম ও বুযুর্গদের এনে ঘরোয়াভাবে পর্দা-পুশিদার সাথে ওয়ায-নসীহত শুনবে। ইনশাআল্লাহ শরীয়তসম্মত উক্ত পদ্ধতিতে তাদের অধিক ফায়েদা হবে।