আদ জাতি পৃথিবীতে অনর্থক স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিসৌধ তৈরি করতো। তারা মহান আল্লাহ ও তার রাসুল হুদ (আঃ)-কে অস্বীকার করেছিল। মহান আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃত অপরাধের কারনে সমুলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাদের ধ্বংস কাহিনী পবিত্র কুরআন মজীদে উল্লেখ করে আমাদেরকে তাদের মতো অনর্থক কাজ করার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। নিম্নে আমরা এ সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি ইনশাআল্লাহ।
‘’আদ সম্প্রদায় রাসুলগনকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল। যখন ওদের ভাই হুদ ওদেরকে বলল, তোমরা কি সাবধান হবে না? আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য এক বিশ্বস্ত রাসুল। অতএব আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো প্রতিদান চাইনা, আমার প্রতিদান তো বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে।
তোমরা তো প্রতিটি উচ্চস্থানে অযথা ইমারত (স্মৃতিস্তম্ভ) নির্মাণ করছ। তোমরা প্রাসাদ নির্মাণ করছ, এই মনে করে যে, তোমরা পৃথিবীতে চিরস্থায়ী হবে।
আর যখন তোমরা আঘাত হান, তখন নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হেনে থাকো। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। ভয় করো তাঁকে, যিনি তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন, সে সকল সম্পদ দিয়ে যা তোমরা জানো। তোমাদেরকে দিয়েছেন চতুষ্পদ জন্তু ও সন্তান-সন্ততি, উদ্যানরাজী ও বহু প্রস্রবন।
নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উপর মহাদিবসের শাস্তির আশংকা করি।
ওরা বলল, তুমি উপদেশ দাও আর নাই দাও উভয়ই আমাদের নিকট সমান। এ তো পূর্ব পুরুষদের রীতিনীতি মাত্র। আর আমাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবেনা।
সুতরাং ওরা হুদকে মিথ্যাজ্ঞান করলো, ফলে আমি তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। এতে অবশ্যই নিদর্শন আছে আছে, কিন্তু অধিকাংশই বিশ্বাস করেনা’’ শু’আরা ২৬/১২৩-১৩৯
আদ নামক দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী জাতির নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন হুদ (আঃ)। তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করতো এবং ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় সৃষ্টি করতো। কিন্তু তারা হুদ (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিল। মহান আল্লাহ তাদের উপর প্রচণ্ড ঝঞ্জাবায়ু পাঠিয়ে তাদেরকে সমুলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই ঝঞ্ঝাবায়ু তাদের উপর আট দিন সাত ও রাত্রি যাবত প্রবাহিত হয়েছিল।
আদ জাতি অযথাই রাস্তার উপর এমন ইমারত বা স্তম্ভ তৈরি করতো যা উচ্চতার একটি নিদর্শন হতো। কিন্তু তাদের উদ্যেশ্য তাতে বাস করা নয়, বরং খেল-তামাশা করা হতো। তারা তাদের শক্তি ও ধনঐশ্বর্যের নিদর্শনরুপে উঁচু উঁচু প্রাসাদ ও স্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। হুদ (আঃ) তাদেরকে প্রতিটি উঁচু স্থানে নিরর্থক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে এই বলে নিষেধ করলেন যে, তোমরা এমন কাজ করছ, যাতে সময় ও সম্পদ উভয় নষ্ট হচ্ছে। আর এতে দ্বীন ও দুনিয়ার কোনোই উপকার নেই। বরং বেকার ও অনর্থক কাজ। অনুরপ তারা বিশাল বিশাল মজবুত প্রাসাদও নির্মাণ করতো, যেন তারা সেখানে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। তারা দুর্বলদের উপর চরম অত্যাচার ও কঠোরতা করতো এবং নিজেদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করতো।
হুদ (আঃ) তাদেরকে এসব থেকে নিষেধ করেন, এবং আল্লাহকে ভয় করার ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেন। হুদ (আঃ) তাদেরকে এ মর্মে সতর্ক করেন যে, যদি তারা কুফরীর উপর অটল থাকে এবং মহান আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে যে নেয়ামত দান করেছেন সে সবের কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে, তাহলে তারা আল্লাহর আযাব তাদের উপর অবধারিত হয়ে পড়বে। এবং সেই আযাব থেকে বাচার কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু আদ জাতি পূর্ব-পুরুষদের রীতিনীতির দোহাই দিয়ে সত্য গ্রহন করতে অস্বীকার করলো। এর মাধ্যমে তারা ইহকালিন আযাব ও পরকালিন আযাব দুটোকেই অস্বীকার করলো।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’স্মরণ করো, আদ জাতির ভ্রাতা হুদের কথা। সে তার আহকাফবাসী সম্প্রদায়কে সতর্ক করে বলেছিল যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো অবাদত করোনা। আমি তোমাদের উপর এক ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করছি।
লোকেরা বলেছিল, তুমি কি আমাদেরকে আমাদে উপাস্যগুলো হতে সরিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের নিকট এসেছ। কাজেই তুমি আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো, যদি তুমি সত্যবাদী হও। হুদ বলল, আযাব কখন আসবে সে বিষয়ের জ্ঞান তো আল্লাহর নিকট। আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি, তাই শুধু তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি। কিন্তু আমি দেখতে আপচ্ছি যে, তোমরা এমন এক জাতি যারা মূর্খের মতো আচরণ করছ।
অতঃপর তারা যখন উপত্যকার দিকে মেঘ আসতে দেখল, তখন তারা বলল- এ তো মেঘ, আমাদেরকে বৃষ্টি দিবে।
না, তা হল সেই জিনিস, যা তোমরা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে চেয়েছিলে। এ হল ঝড়, যাতে আছে ভয়াবহ আযাব। ওটা তার প্রতিপালকের নির্দেশে সবকিছু ধ্বংস করে দিবে। অতঃপর (ঐ ঝড়ে) অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বসতিগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অপরাধী জাতিকে আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি।
তাদেরকে আমি যতটা সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম, তোমাদেরকে তেমন সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিনি।। আর তাদেরকে দিয়েছিলাম কান, চোখ ও হৃদয়। কিন্তু তাদের কান, তাদের চোখ আর তাদের হৃদয় তাদের কোনো উপকারে আসেনি যেহেতু তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করতো। তারা যা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো তা-ই তাদেরকে ঘিরে ফেলল।
আমি ধ্বংস করেছিলাম তোমাদের চারপাশের জনপদ। আমি নানাভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম যাতে তারা সঠিক পথে ফিরে আসে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্যেশ্যে যাদেরকে তারা ইলাহরুপে গ্রহন করেছে তারা তাদেরকে সাহায্য করলো না কেন? বরং তাদের কল্পিত ইলাহ তাদের থেকে হারিয়ে গেল। আসলে তা ছিল তাদের মিথ্যাচার আর মনগড়া উদ্ভাবন’’ আহকাফ ৪৬/২১-২৮
আদ জাতি ছিল পৃথিবীর শক্তিশালী জাতিদের মধ্যে অন্যতম। যাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ ‘’এ রকম জাতি পৃথিবীতে সৃষ্টিই হয়নি’’ ফাজর ৮৯/৮
অর্থাৎ তারা এমন এক জাতি, যারা শক্তি, ক্ষমতা ও প্রতাপের দিক দিয়ে অনন্য। তারা ছিল অতি দীর্ঘকায় ও প্রচণ্ড শক্তিশালী। সে জন্যই তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করতো। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করতো এবং বলতো, আমাদের থেকে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে’’ হা-মীম আস-সাজদাহ (ফুসসিলাত) ৪১/১৫
মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের এই মিথ্যা আস্ফালনের প্রতিবাদে ধমক স্বরূপ বলেছেনঃ ‘’ওরা কি লক্ষ্য করেনি যে, আল্লাহ- যিনি ওদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি ওদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী? আর ওরা আমার নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করতো’’ হা-মীম আস-সাজদাহ (ফুসসিলাত) ৪১/১৫
কিন্তু যখন আদ জাতি কুফরী পরিত্যাগ করে ঈমান আনয়ন করলো না, তখন মহান আল্লাহ তায়ালা এই শক্তিশালী জাতির উপর আযাব স্বরূপ কঠিন ঝর প্রেরন করলেন, যা অবিরত সাত রাত আত দিন তাদের উপর বয়েছিল। ঝরো বাতাসে বিকট আওয়াজ ছিল। প্রবল এই ঝর একেকটি মানুষকে উপরে তুলে মাটিতে আছড়ে দিয়েছিল, যার কারনে তাদের মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে গিয়েছিল। এবং তাদের মৃতদেহগুলো বিনা মাথায় এমনভাবে মাটির উপর পরেছিল, যেন টা খেজুরের সারশূন্য কাণ্ড। তারা পাহাড় কেটে, পাহাড়ের গুহায় বিশাল বিশাল প্রাসাদ তৈরি করেছিল, পানির জন্য গভীর কুপ খনন করেছিল এবং বহু বাগানের মালিক ছিল। কিন্তু যখন আল্লাহর আযাব এসে পৌঁছল, তখন এ সমস্ত জিনিস তাদের কোনো উপকারে এলো না। বরং তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’আদ জাতি সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, ফলে কতো ভয়ংকর আমার আযাব ভীতি প্রদর্শন। আমি তাদের উপর পাঠিয়েছিলাম ঝঞ্ঝাবায়ু এক অবিরাম অশুভ দিনে। মানুষকে তা উৎপাটিত করেছিল যেন তারা উৎপাটিত খেজুর গাছের কাণ্ড। ফলে কতো ভয়ংকর ছিল আমার আযাব ও ভীতি প্রদর্শন’’ ক্বামার ৫৪/১৮
আদ জাতির ইহকালীন শাস্তিঃ
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’সামুদ ও আদ জাতি সুনিশ্চিত আকস্মিক মহাদুর্ঘটনাকে অস্বীকার করেছে। ফলে সামুদ জাতি এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আর আদ জাতিকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝরো হাওয়া দিয়ে। যা তাদের উপর প্রবাহিত হয়েছিল সাত রাত আট দিন বিরামহীনবভাবে, যদি তুমি দেখতে তারা পড়ে আছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, যেন তারা পুরাতন খেজুর গাছে কাণ্ড। তুমি তাদের কাউকে রক্ষা পেয়ে বেঁচে থাকতে দেখেছো কি?” হাক্কাহ ৬৯/৬
কিন্তু পরকালের কঠিন আযাব তাদের উপর অবশিষ্ট রয়ে গেছেঃ
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ ‘’অতঃপর আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাবার জন্য কতিপয় অশুভ (তাদের জন্য) দিনে ওদের উপর ঝরো হাওয়া প্রেরন করেছিলাম। আর পরকালের শাস্তি তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং ওদেরকে সাহায্য করা হবে না’’ হা-মীম আস-সাজদাহ (ফুসসিলাত) ৪১/১৬
মহান আল্লাহ তায়ালা দুর্ধর্ষ আদ জাতির করুন পরিনতি সম্পর্কে সতর্ক হয়ে শিক্ষা গ্রহনের নিমিত্তে আমাদের জন্য নসিহত করে বলেছেনঃ ‘’আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহনের জন্য, উপদেশ গ্রহনের কেউ আছে কি?’’ ক্বামার ৫৪/২২
“তুমি কি দেখনি, তোমার প্রতিপালক আদ জাতির সাথে কিরুপ আচরণ করছিলেন?’’ ফাজর ৮৯/৬
“এরপরও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে ওদেরকে বল, আমি তোমাদেরকে এক ধ্বংসকর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি, যেরুপ শাস্তির সম্মুখিন হয়েছিল আদ ও সামুদ” ‘ হা-মীম আস-সাজদাহ (ফুসসিলাত) ৪১/১৩
পূর্ববর্তী জাতিরা যে সমস্ত কাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহর আযাবে ধ্বংস হয়ে গেছে আমরা সবাই যেন সে সমস্ত কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সকল গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে থেকে সঠিকভাবে মহান আল্লাহ তায়ালার বানী কুরআন ও রাসুল (সাঃ)-এর হাদীস অনুসরন করার তৌফিক দান করুন।
সুত্রঃ
তাফসীর ইবন কাসীর।
তাফসীর আহসানুল বায়ান।
তাফসীর যাকারিয়া।
তাফসীর মা’আরেফুল কুরআন।
[সংগ্রহ:ANISUR RAHMAN এর ফেসবুক নোট থেকে]