মাওলানা লিসানুল হক শাহরূমী
রসূলুল্লাহ সঃ বলেছেনঃ
“তোমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই তার ভাইয়ের দর্পণ স্বরূপ ৷ সুতরাং যদি সে তার ভাইয়ের মধ্যে কোনো খারাবী দেখে–তাহলে সে যেন তা দূরীভূত করে”৷ ( রাবী আবূ হুরায়রাহ রদ্বি:, তিরমিযী)
এই উপমায় এমন পাঁচটি জ্যোতির্ময় ইঙ্গিত পাওয়া যায়; যার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি আপনার বন্ধুত্বকে বাস্তবেই একটি আদর্শ বন্ধুত্বে রূপান্তর করতে পারেন৷
(১) আয়না আপনার দাগ ক্ষত তখনই প্রকাশ করে, যখন আপনি তা দেখার জন্যে আয়নার সামনে দাঁড়ান৷ নয় তো সেও পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে৷
তদ্রুপ আপনিও আপনার বন্ধুর দোষ ত্রুটি তখনই প্রকাশ করুন; যখন সে নিজেই সমালোচনার জন্যে আপনার সকাশে পেশ করে এবং হৃষ্টচিত্তে সমালোচনার সুযোগ দেয়, আর আপনিও উপলব্ধি করতে পারেন যে, তার মন এখন সমালোচনা শুনতে প্রস্তুত এবং সংশোধন কবুল করতে আগ্রহ ঢেউ খেলছে৷ যদি এরকম অবস্থা না দেখেন, তবে প্রজ্ঞার সাথে আপনি নীরবতা অবলম্বন করুন এবং বিষয়টি অন্য সময়ের জন্য তুলে রাখুন৷ আর তার অবর্তমানে এতোটাই সতর্কতা অবলম্বন করুন যে, আপনার মুখে এমন কোনো শব্দ যেন না আসে; যা তার দোষের প্রতি ইঙ্গিতবহ হয়৷ কারণ এটা গীবত আর গীবতের দ্বারা দীল গড়ে না, বরং ভাঙ্গে৷
(২) আয়না চেহারার সেসব ক্ষতচিহ্নকেই সঠিকভাবে প্রকাশ করে; যা তখন চেহারায় বিদ্যমান থাকে৷ না সে কম বলে, না সংখ্যা বাড়িয়ে উপস্থাপন করে৷ তারপর সে শুধু চেহারার সেসব দাগকেই দেখায় যা তার সামনে আসে৷
সে লুকিয়ে থাকা দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান করে না, আর না খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দোষত্রুটির কাল্পনিক কোনো চিত্র পেশ করে৷
তদ্রুপ আপনিও বন্ধুর দোষত্রুটি কম বেশি না করে বর্ণনা করুন৷ অতি মানবতা আর খোশামোদে গোপনও করবেন না, আবার বাগ্মীতা দিয়ে বাড়িয়েও বলবেন না৷ শুধু সেসব দোষই বলুন যা সাধারণত জীবনে প্রকাশ পায় ৷ অনুসন্ধান আর তদন্তের পেছনে পড়বেন না৷
(৩) আয়না সমুদয় উদ্দেশ্য ও স্বার্থ থেকে পবিত্র হয়ে নিজের কর্তব্য আদায় করে৷ যে ব্যক্তিই তার সামনে চেহারা পেশ করে, তার সঠিক নকশা প্রকাশ করে৷ না সে কারো সাথে বিদ্বেষ রাখে, না কারো কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়৷
তদ্রুপ আপনিও ব্যক্তিগত স্বার্থ, প্রতিশোধ পরায়ণতা, বিদ্বেষ ও সব ধরনের অসদিচ্ছা থেকে পবিত্র হয়ে স্বাভাবিক সমালোচনা করুন এবং এই উদ্দেশ্যেই করুন যেন আপনার বন্ধু নিজেকে শুধরে নেয়; যেরকম আয়না দেখে মানুষ নিজেকে সাজিয়ে শুধরে নেয়৷
(৪) আয়নায় নিজের আসল অবয়ব দেখে- না কেউ বকাঝকা করে, না রাগে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে আয়না ভেঙ্গে ফেলার নির্বুদ্ধিতা করে৷ বরং সাথে সাথেই নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং মনে মনেই আয়নার মূল্য অনুভব করে৷ সময়ের ভাষায় তার শুকরিয়া আদায় করে আর বলে, বাস্তবেই আয়নাটা আমার সাজ সজ্জায় দারুণ সহায়তা করেছে! আর স্বভাবজাত কর্তব্য আদায় করেছে৷ অতঃপর খুব সতর্কতার সাথে অন্য সময়ের জন্যে হেফাযতে রাখে৷
তদ্রুপ আপনিও বন্ধুর সমালোচনায় জবাবি হামলা করে বসবেন না৷ বরং তার শুকরিয়া করুন যে, সে বন্ধুত্বের হক আদায় করেছে ৷ শুধু যবানে নয়, মনে মনেও কৃতজ্ঞ হয়ে তৎক্ষণাত নিজের সংশোধনে ব্যপৃত হোন আর বন্ধুর মূল্য উপলব্ধি করুন আর অনুরোধ করুন যেন আগামীতেও এভাবে তার মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে কৃতজ্ঞ করে৷
(৫) মুসলমানদের মধ্যে প্রত্যেকে তার ভাইয়ের আয়না এবং ভাই ভাইয়ের নিষ্ঠা ও ভালোবাসার দর্পণ৷ ওয়াফাদার ও কল্যাণকামী হয়৷ সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হয় ৷ ভাইকে বিপদে দেখে কেঁদে ওঠে আর খুশিতে দেখে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায় ৷ অতএব, ভাই ও বন্ধু যে সমালোচনা করবে তাতে অতিশয় মর্মজ্বালা ও সহমর্মিতা থাকবে ৷ ভালোবাসা ও নিষ্ঠা থাকবে ৷ সীমাহীন সহানুভূতি ও হিতাকাঙ্খা থাকবে, আর প্রতিটি শব্দ হবে সংশোধনের প্রবল আগ্রহের দর্পণস্বরূপ৷
আর এরকম সমালোচনার দ্বারাই হৃদয়ের বন্ধন তৈরি ও জীবনকে সাজানোর প্রত্যাশা করা যেতে পারে৷
রসূলুল্লাহ সঃ বলেনঃ যে ব্যক্তি অন্যের দোষ তালাশ করে-মহান আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করার ইচ্ছা করেন-আর যার দোষ আল্লাহ প্রকাশ করার ইচ্ছা করেন-আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্চিত করেই ছাড়েন ৷ যদিও সে ঘরের কোণেই বসে থাকে৷