একজন শ্রমিক কাজ করছে। রাজমিস্ত্রি। পাঁচতলার ওপর নিবিষ্ট মনে কাজে মগ্ন।
হঠাৎ বাঁশ ভেঙে নিচে পড়ে গেল! নিচে ছিল বালির ট্রাক। সরাসরি বালির ওপর পড়েছে। তেমন ব্যথা পায়নি। নতুন জীবন পেয়ে খুশি আর ধরে না। পাঁচতলা থেকে পড়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। ভাগ্যচক্রে বালির ট্রাক ছিল বলে রক্ষা! আনন্দে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে চাইল। মিষ্টি কিনতে রাস্তার ওপারে যেতে হবে। রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে গাড়িচাপায় মৃত্যু হয় ওই শ্রমিকের!
মানুষ মরণশীল। আগের কেউ নেই, এখন যারা আছে একসময় তারাও কেউ থাকবে না। থাকবে না আগামী প্রজন্মের কেউই। সৃষ্টির শুরুলগ্ন থেকে অযুত-নিযুত-অগণিত কোটি বনি আদম দুনিয়ায় এসেছে; কেউ থাকেনি। চলে গেছে। যেতে বাধ্য। পাপীতাপী-গোনাহগার, নেককার-বুযুর্গ, ধনী-গরিব-অসহায়, সম্পদশালী-প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান-বিত্তবান, এমনকি নবী-রাসুলগণ পর্যন্ত থাকতে পারেনি।
দুনিয়া মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। নারী-বাড়ি-গাড়িতে মুগ্ধ সে। বিত্ত ও চিত্ত নিয়েই মত্ত। নফসের সকল চাহিদা পূরণ করাই যেন মানুষের পরম লক্ষ্য। সাধ্যের ভেতরে সব কাজই করে সে। সাধ্য থাকলে আকাশ পাড়ি দিয়ে কিংবা পাতাল ফুড়ে চলে যেত। কিন্তু মানুষের শক্তি ও ক্ষমতা সীমিত। এ সীমিত ক্ষমতা নিয়েই তার সে কী আস্ফালন! একটি মুহূর্তেও সে ভাবে না, কে তাকে পাঠিয়েছে? কী উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছে? কোত্থেকে এসেছে? কোথায় যাবে? অনিবার্য মৃত্যুর দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে, তবুও সে মাতাল! সে মরতে চায় না। আরও কিছুদিন থাকতে চায়। অথচ মৃত্যু তার সন্নিকটেই! পায়ের নিচে, মাথার ওপরে।
মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় আসলেন আবুবকর রা.। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ভীষণ অসুস্থ। ভয়ানক জ্বর। জ্বরাক্রান্ত শরীর নিয়ে আবৃত্তি করলেন :
كُلُّ امْرِئٍ مُصَبَّحٌ فِى أَهْلِهِ * وَالْمَوْتُ أَدْنَى مِنْ شِرَاكِ نَعْلِهِ
অর্থ : প্রত্যেকেই নিজ পরিবারে বসবাস করছে; অথচ মৃত্যু তার জুতার ফিতার চেয়েও নিকটে!
(সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৫৩৩০)
বদকার, গোনাহগার, কাফের-মুশরিক– এরা দুনিয়া ত্যাগ করতে চায় না। খড়কুটো আঁকড়ে হলেও দুনিয়ায় থাকতে চায়। অমরত্বের সন্ধানে রাজা-বাদশাদের হাস্যকর, অলীক ও কাল্পনিক কর্মকা-গুলোই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে তারা অন্ধকারে। তাই দুনিয়া ছাড়তে চায় না।
মৃত্যু মুমিনের হাদিয়া
পক্ষান্তরে মৃত্যু মুমিনের ভয়ের কারণ ও উপকরণ নয়। শান্তি ও প্রশান্তির আশ্রয়। মহান রবের পক্ষ হতে মুমিন বান্দার কাছে প্রেরিত বিশেষ হাদিয়াস্বরূপ মৃত্যু। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন :
تُحْفَةُ الْمُؤْمِنِ الْمَوْتُ
‘মৃত্যু মুমিনের জন্যে হাদিয়াস্বরূপ।’
কারণ, মৃত্যুই তাকে পুরস্কারের মঞ্চে নিয়ে যায়। রব্বে কারিমের দর্শনের রাস্তা দেখায়। সৃষ্টিকর্তাকে দেখার চেয়ে পরম ও চরম সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! কোলাহল, হলাহল, মারামারি, কাটাকাটি, ফেতনাফাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা-শত্রুতা, পাপ-পঙ্কিলতার অভিশপ্ত স্থান হতে চির সুখ-শান্তির জান্নাতে যাওয়ার সোপান হল মৃত্যু। তাই মৃত্যুই মুমিনের কাক্সিক্ষত ও লালিত স্বপ্ন। উপরের হাদিসের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী রহ. কত চমৎকার বলেছেন :
لأنه وسيلة السعادات الأبدية وذريعة الوصول إلى محضر القدس ومحفل الأنس فالنظر متوجه إلى غايته معرض عن بدايته من الفناء والزوال والتمزق والاضمحلال.
নিরাপত্তার চাদর ভেদ করেই মৃত্যু আসে
সকলের মৃত্যুই নির্ধারিত সময়ে আসে। একমুহূর্ত আগেও না, পরেও না। মৃত্যুকে বাধা দিয়ে রাখা যায় না। মৃত্যু কপালে থাকলে আসবেই আসবে। যেখানে যেভাবে হওয়ার কথা সেখানে সেভাবেই হবে। শত নিরাপত্তার চাদর ভেদ করেই আসবে। তাকে প্রতিহত ও দমন করার শক্তি কারোরই নেই। পৃথিবীর অনেক প্রতাপশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির কাছে মৃত্যু গিয়ে হাজির; অথচ তাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছিল! চাদর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়!! শেখ মুজিব থেকে জিয়া, ইন্দিরা গান্ধি থেকে রাজিব গান্ধি হয়ে বেনজীর ভুট্টো সবাই নিরাপত্তার চাদর গায়ে জড়িয়েই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। নিñিদ্র নিরাপত্তায় ছিদ্র খোঁজে পেতে মৃত্যুদূতের কোনো বেগ পেতে হয় না!
ইসলামে মৃত্যুর গুরুত্ব
কুরআনে কারিমে সর্বোচ্চ ৫০০ আয়াতে বিধিবিধানের আলোচনা রয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আয়াতে; প্রায় একহাজার আয়াতে মৃত্যু ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে! এত্থেকেই ইসলামে মৃত্যুর গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়।
মৃত্যু এক অমোঘ ও চিরন্তন সত্য। অনিবার্য পরিণতি মৃত্যু। চাইলেও মৃত্যুবরণ করতে হবে, না চাইলেও। মৃত্যু একদিন সাক্ষাৎ করবেই; আমার সাথেও, আপনার সাথেও, তার সাথেও। সকলের সাথেই সাক্ষাৎ করবে। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :
قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلاقِيكُمْ
অর্থ : যে মৃত্যু থেকে তোমরা পলায়ন করছ; তা একদিন অবশ্যই তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে।
সুতরাং ধেয়ে আসছে অনিবার্য মৃত্যু, আমি কি প্রস্তুত? অনন্তকালের যাত্রী! পাথেয় ছাড়াই রওয়ানা করে দিলেই হবে? পাথেয় আছে কি?
হযরত খুবাইবের ঐতিহাসিক কবিতা
হযরত খুবাইব রা. একজন বিখ্যাত সাহাবি। কাফেরদের বন্দিশালায় ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরওয়ানা তাঁকে শুনানো হল। বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। শান্তশিষ্ট। আগের মতোই। শুধু বললেন, আমাকে দুই রাকাত নামায পড়ার সুযোগ দাও। দ্রুত নামায পড়ে বললেন, আমি আরও নামায পড়তাম; কিন্তু তোমরা ভাববে, আমি মৃত্যুর ভয়ে তটস্ত, সন্ত্রস্ত। তখন কাফেরদের নাম ধরে ধরে বদদোয়া করেন এভাবে : اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا
এরপর তিনি হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে আবৃত্তি করেন :
فَلَسْتُ أُبَالِي حِيْنَ أُقْتَلُ مُسْلِماً * عَلَى أيِّ جَنْبٍ كَانَ للهِ مَصْرَعِي
وَذَلِكَ في ذَاتِ الإلَهِ وإنْ يَشَأْ * يُبَارِكْ عَلَى أوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
‘আমি মুসলিম হয়ে মৃত্যুবরণ করাতে পরওয়া করি না। যেভাবেই মৃত্যু হোক আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তেই আমার এ মৃত্যু। দয়াময় চাইলে আমার দেহের কর্তিত নিথর অঙ্গগুলোত বরকতের বারিধারা প্রবাহিত করতে পারেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ৩৭৬৭)
আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করে, মৃত্যুর পরওয়ানা শোনার পর হৃদয়ের অনুভূতি কেমন হয়? সে অনুভূতি কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? বলেকয়ে বোঝানো সম্ভব? কলমের কালি নয় কলবের গভীরতা দিয়েই অনুভব করা সম্ভব; যৎকিঞ্চিৎ হলেও।
[মাওলানা মুহিউদ্দীন কাসেমী]