মানব জাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহ্বান জানিয়েছেন। আর নবীদের ধারাবাহিকতা শেষ হয়েছে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। তাই তিনি শেষ নবী ও রাসূল।
তিনি ইলমে ওহী অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত ইলমের মাধ্যমে পারিচালিত হতেন। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পূর্বে উম্মাতের হিদায়েতের জন্য কুরআন ও সুন্নাহ রেখে গেছেন। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর যুগ যুগ ধরে কুরআন ও সুন্নাহর ইলমের ভিত্তিতে মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন সম্মানিত আলিমগণ।
তারা একদিকে আল্লাহর রাসূলের রেখে যাওয়া কুরআন ও সুন্নাহর ইলমকে বক্ষে ধারণ করেছেন, অপরদিকে এর প্রচার-প্রসারেও ব্যাপক ভূমিকা পালন করছেন। সেজন্য ইসলামে ইলম এবং আলিমের গুরুত্ব অত্যধিক।
আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা ইলমের গুরুত্ব ও আলিমের মর্যাদা এবং আলিমের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
ইলমের পরিচয়
ইলম অর্থ জ্ঞান যা অজ্ঞতার বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে, ইলম দ্বারা যা উদ্দেশ্য তা সুন্দরভাবে প্রকাশ পেয়েছে ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম (র.) এর প্রদত্ত সংজ্ঞায়। তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন তা-ই ইলম।’
ইলমের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইলম অর্জন সম্পদ অর্জনের চেয়ে উত্তম
সম্পদ অর্জনের প্রতি প্রতিটি মানুষেরই বিশেষ আগ্রহ থাকে। আর ইলম অর্জনের মাধ্যমে তার চেয়ে ও উত্তম সম্পদ লাভের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে উকবা ইবন আমের রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কোন ব্যক্তির এটা পছন্দ যে, সে আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়াই এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট না করে বুতহান অথবা আকীক প্রান্তরে গিয়ে দু’টো বিশালকায় উট নিয়ে আসবে?’ আমরা বললাম, আমাদের সবারই তা পছন্দ। তিনি বললেন, তোমাদের কেউ কি কোন সকালে মসজিদে গিয়ে আল্লাহর কুরআন হতে দু’টি আয়াত পড়ে না বা শিক্ষা দেয় না? তাহলে সেটি তার জন্য দু’টি উট লাভ করার চেয়ে উত্তম হবে। তিনটি আয়াত তিনটি উট অপেক্ষা উত্তম। চারটি আয়াত চারটি উট অপেক্ষা উত্তম। অনুরূপ আয়াতের সংখ্যা অনুপাতে উটের সংখ্যা অপেক্ষা উত্তম।’ [সহীহ মুসলিম: ১৩৩৬]
ইলম অর্জন একটি উত্তম জিহাদ
জিহাদ অর্থ প্রচেষ্টা চালানো। বর্তমান সময়ে জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হলে ইলম অর্জন খুবই জরুরি। আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জিহাদ হলো বিভিন্ন বিষয়ে ইলম অর্জন করা। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সুতরাং তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না এবং তুমি কুরআনের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম (জিহাদ) কর।’ [সূরা আল-ফুরকান: ৫২] ইবনুল কায়্যিম রহ. কুরআনের সাহায্যে জিহাদ করাকে বড় জিহাদ বলে উল্লেখ করেছেন। [মিফতাহু দারিস সাআদা : ১/৭০]
ইলম মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে
ইলম এমন একটি বিষয় যা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয় এর পূর্বে যাদেরকে ইলম দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে যখন এটা পাঠ করা হত তখন তারা সিজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ত।’ [সূরা বনী ইসরাঈল: ১০৭]
আমল করার পূর্বে ইলম অর্জন অপরিহার্য
আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে তার ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর তাই ইবাদাত পালনের পূর্বে এ বিষয়ে ইলম হাসিল করা জরুরি। তা নাহলে সহীহভাবে ইবাদাত পালন করা যাবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।’ [সূরা মুহাম্মদ: ১৯]
ইমাম বুখারী (রহ.) তাঁর সহীহ বুখারীতে একটি অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন এইভাবে, ‘আল ইলমু ক্বাবলাল ক্বাওলি ওয়াল আমাল’ অর্থ: কথা ও কাজের পূর্বে ইলম অর্জন করা জরুরি। ইলম অর্জন জান্নাতে যাওয়ার পথে সহায়ক।
একজন মুসলিমের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো জান্নাত পাওয়া। আর ইলম হাসিলের মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সহজ হয়ে যায়। মা আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ আমার প্রতি ওহী করেছেন, যে ব্যক্তি ইলম অর্জনে কোনো রাস্তা অবলম্বন করে, আমি তার জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেই।’ [বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান: ৫৩৬৭] ইলম অর্জনে ইর্ষা পোষণ করা বৈধ
আল্লাহ তাআলা কেবল দুটি বিষয়ে পরস্পর হিংসা (ঈর্ষা) পোষণ বৈধ রেখেছেন: তা হল সম্পদ এবং ইলম। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কেবল দুই ব্যক্তিকে হিংসা করার অনুমতি রয়েছে: ওই ব্যক্তিকে যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন। অতঃপর তাকে সে সম্পদ হকের পথে ব্যয় করার তাওফীক করেছেন। আর ওই ব্যক্তি যাকে তিনি হিকমাহ বা ইলম দান করেছেন। ফলে সে তা দিয়ে বিচার করে এবং তা শিক্ষা দেয়।’ [সহীহ বুখারি: ৭৩]
ইলম জ্ঞানীর জন্য আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ
আল্লাহ যাকে দীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দান করেন তিনিই প্রকৃত নেয়ামাত ও তাওফিক প্রাপ্ত। কেননা দ্বীনী বিষয়ে প্রাজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্য আল্লাহর এক মহাদান। মুআবিয়া ইবন সুফিয়ান রাদিআল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তিনি তাকে দ্বীনের বিষয়ে গভীর ইলম দান করেন।’ [সহীহ বুখারি: ৭৩১২]
ইলম জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্যকারী
ইলম আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নিয়ামাত। যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, বল, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে। [সূরা যুমার: ০৯]
ইলম অর্জন করা ফরজ/ফরজ ইবাদাত
দ্বীন ও দুনিয়ায় সফলতা লাভ করতে হলে ইলম অর্জন অতি জরুরি। তাই ইলম অর্জনকে ইসলামে ফরয করা হয়েছে। আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইলম অণে¦ষণ করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ [সুনান ইবনে মাজাহ।
আলিমের মর্যাদা
আলিমগণ নবীগণের ওয়ারিশ
আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদের মধ্যে প্রিয় হচ্ছেন নবীগণ। একজন সত্যিকারের আলিম নবীদের উত্তরাধীকারী হিসেবে মর্যাদা পাবার অধিকারী। এটি কতইনা সৌভাগ্যের বিষয়। তাইতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিমের মর্যাদা সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘আলিমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী, আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে দিনার ও দিরহাম রেখে যাননি। তাঁরা উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন ইলম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে বিপুল অংশ লাভ করেছে। [সুনান আবু দাউদ: ৩৬৪৩]
মৃত্যুর পরও আলিমের আমল জারি থাকে
মানুষ মৃত্যুবরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আলিমের আমল জারি থাকে। একজন আলিম জীবিত অবস্থায় ইলম বিতরণ করার কারণে অনেকে উপকৃত হয়েছেন, সেজন্য মৃত্যুবরণ করার পরও তার সওয়াব তিনি পাবেন। এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি উৎস থেকে তা অব্যাহত থাকে : সাদাকায়ে জারিয়া, উপকারী ইলম ও নেক সন্তান যে তার জন্য দু‘আ করে।’ [সহীহ মুসলিম: ৪৩১০]
সকল সৃষ্টি আলিমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে
কুরআন-সুন্নাহর ইলমে সমৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য বড়ই সুসংবাদ যে, তাঁর জন্য আল্লাহর নিকট সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে।
আনাস ইবন মালেক রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইলমের অধিকারী ব্যক্তির জন্য সব কিছুই বা ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত [সহীহ মুসনাদ আবী ইআলা: ২/২৬০]