আল্লাহ পাক কুরআনের শব্দ ও অর্থের পাশাপাশি এর নুত্বক বা উচ্চারণ পদ্ধতিও সংরক্ষণের ওয়াদা করেছেন । পবিত্র কুরআনের সূরাতুল হিজরে তিনি বলেন: إنا نحن نزلنا الذكر وإنا له لحافظون
অর্থ্যাৎ- আমিই এই কুরআন অবতীর্ণ করেছি, আমিই একে সংরক্ষণ করব ৷
কুরআনের এই সংরক্ষণবাণীর মাঝে শব্দ, নুত্বক ও অর্থ সবই অন্তর্ভুক্ত । এর কোনো কিছুতে কেউ কখনও কোনো অবস্থায় কোনো পরিবর্তন করতে পারবে না । সক্ষম হবে না একটি হরকতেরও বেশকম করতে ।
ঠিক যেভাবে যে উচ্চারণে যে পদ্ধতিতে যে কাইফিয়্যাতে যে লাহানে যে টানে জীবরীল আমীন রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শিখিয়েছেন, পৌঁছিয়েছেন; হুবহু সেভাবে সে উচ্চারণে সেই যবর, যের, পেশ, সাকিন ও তাশদীদের সাথে কুরআন অপরিবর্তনশীল ও অপরিবর্ধনশীল থাকবে । এটিই হলো কুরানের মু’জিয হওয়ার সবচেয়ে বড় দিক ।
যখনই কেউ এর কোন বিষয়ে তাহরীফ করতে চেয়েছে তখনই উম্মতের উলামাদেরকে আল্লাহ পাক এদের মোকাবিলায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন । তাঁরা নিজেদের উজাড় করে দিয়ে কুরআন হেফাজতের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন । যার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রের ৷ ইলমের বিভিন্ন শাখার ।
কুরআনের এই সঠিক উচ্চারণ বা নুত্বক, যা রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত জীবরীল আ. এর মাধ্যমে ধারণ করেছেন কেয়ামত পর্যন্ত সকল উম্মতের কাছে তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতেই একদল উলামা ইলমুত তাজভীদ শাস্ত্র চালু করেন ।
যাতে জিবরীল আমীন থেকে ধারণকৃত রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঠিক কুরআনের উচ্চারণ, লিখা ও ‘মুশাফাহাতুত তালেব আন শায়খিহী’ এর মাধ্যমে উলামায়ে উম্মত একত্রিত করেছেন । কুরআনের মুতাওয়াতির শব্দাবলী ও কেরাতগুলোর সংরক্ষণের জন্য তাসনীফ ও কুররা তৈরির মাধ্যমে ইলমুল কেরাত শাস্ত্রের প্রারম্ভ করেন । ঠিক তেমনি কুরআনের অর্থ ও মর্ম অক্ষুণ্ণ রাখতে ইলমুত তাফসীরের উদ্ভাবন করেন ।
কুরআনের অন্যান্য প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক সকল শাখায় জীবরীল আমীন থেকে রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ধারণকৃত সঠিক বিষয়গুলোর সংরক্ষণ করণার্থে প্রত্যেক যুগেই একদল নিবেদিতপ্রাণ, ফনের খুটিনাটি সব বিষয়ের পারদর্শী আলেম তৈরীর পাশাপাশি ‘উলূমুল কুরআন’ নামক শাস্ত্র তারা প্রস্তুত করেন ।
বর্তমান ফেৎনা ও রসমের এ যমানায় হক্কানী আহলে ইলম উলামা হযরত এবং উলূমুল কুরআন ওয়াল কেরাত ওয়াত তাজভীদের কর্ণধারগণ প্রচলিত টানাটানি বা মাকামার মাধ্যমে কুরআন তিলাওয়াতের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করে গেছেন, করে যাচ্ছেন । কারণ, এই পদ্ধতি রাসূলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্বীকৃত নয় ।
জিবরীল আমীন তাকে এভাবে কুরআন শিখাননি, তিনিও সাহাবাদেরকে এভাবে শিক্ষা দেননি, সাহাবারাও পরবর্তীদেরকে এ পদ্ধতিতে কুরআন শিখাননি । এটি নব আবিষ্কৃত একটি ‘বিদআত ফি তিলাওয়াতিল কুরআন’ । যার গোড়াপত্তন হয় দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষ দিকে, আবু হাতেম উবাইদুল্লাহ বিন আবু বাকরা-এর মাধ্যমে । তাও তখন স্রেফ “আলহান “ এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
আলহান বলা হয়, তাজভীদের আওতার বাইরে, স্বাভাবিক স্বরকেই কিছু বাড়িয়ে টেনে টেনে পড়া, বাংলা গীত এর ন্যায় । তাই উলামায়ে কেরাম তখন এ বিদআত আবিষ্কারের কারণে তাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন ।
পরবর্তীতে আস্তে আস্তে বিষয়টি উন্নতি লাভ করে এবং বর্তমানে তা রোম, পারস্য ও ইরান কর্তৃক আবিষ্কৃত মিউজিকের ওজনের সাথে মিলিয়ে যার মাকামগুলো صنع بسحرك (সুনিআ বিসিহরিক) এই শব্দের মাঝে লুকায়িত ৷
صنع بسحرك (সুনিআ বিসিহরিক) এর সোয়াদ দিয়ে মাকামুস সোয়াবা, নূন দিয়ে নাহাওয়ান্দব আইন দিয়ে আজম, বা দিয়ে বায়াত, সিন দিয়ে সিগা, হা দিয়ে হিজায, রা দিয়ে রাসত, কাফ দিয়ে কারদ বুঝায় ।
এসব নাম দেখেই তো বুঝা যাচ্ছে যে, এগুলো আরবী নয়, পারস্য থেকে আমদানীকৃত ।
উপরন্তু বলা যায়, এগুলো যদি আরবীও হতো, তবুও এগুলোর স্বরের ওজন অনুযায়ী কুরআন পাঠ বৈধ হতো না । কারণ গানের স্বরে কুরআন পড়া উলামাদের ঐক্যমতে হারাম । এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত বিবরণ আসবে ইনশাআল্লাহ ।
কথা হলো, এই মাকাম অনুযায়ী-ই বর্তমানের কারীরা বিভিন্ন জায়গায় কুরআন পড়ে এবং পড়ায় । বিভিন্ন মিউজিক স্কুলে ভর্তি হয়ে বা এই শাস্ত্রে পারদর্শী বিভিন্ন কারী ও মানুষদের কাছে গিয়ে তারা এই মাকামা শিখে । বর্তমানে মিশরের রেডিওতে কেউ কুরআন পড়ার জন্য গেলে আগে কোন মিউজিক স্কুলে গিয়ে এগুলো শিখেছে কিনা তার প্রত্যয়নপত্র চায় ৷
মাক্বামা বা টানাটানি করে কুরআন পাঠ নাজায়েয ও বিদআত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে । তন্মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ উল্লেখ করা হল-
এই স্বরে কুরআন পাঠ, শিখা, শিখানো ও সমর্থন জিবরীল আমীন রাসুলুল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবা, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন ও আইম্মায়ে কুররা কারও থেকেই প্রমাণিত নয় । বরং নুছুছে কুরআনী, রাসুলের হাদীস, সাহাবা তাবেঈন ও আইম্মায়ে কুররাদের আমল ও বক্তব্যে এটি বিদআত ও নাজায়েজ হওয়া সুস্পষ্ট ৷
লিখেছেন: মুফতি আবরারুল ইসলাম