গ্রামে বা শহরে কোনো পুরুষ বা নারী মৃত্যুবরণ করলে লাশের কাফন-দাফনে অনেক ক্ষেত্রে বেশ বিলম্ব করা হয়। গ্রাম থেকে শহরে বা শহর থেকে গ্রামে আত্মীয়স্বজন আসার অপেক্ষা করা হয়। কিংবা শহর থেকে লাশকে গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রয়োজনে হিমাগারেও রাখা হয়। আর মৃত ব্যক্তি নামি-দামি বা বিশেষ ব্যক্তি হলে বিভিন্ন স্থানে লাশ রাখা হয়, কয়েক দফা জানাযার নামায আদায় করা হয়। আবার কেউ দেশের বাইরে মারা গেলে তাকে দেশে এনে দাফন করা হয়। এতে ২, ৪, ৬ মাসও বিলম্ব হয়ে যায়। তাই জানার বিষয় হল, লাশের প্রতি এরূপ আচরণ সম্পর্কে শরীয়তের দৃষ্টিভঙ্গি কী? দয়া করে বিস্তারিত দলিল-প্রমাণের আলোকে জানিয়ে বাধিত করবেন।
প্রশ্নে মূলত দুটি বিষয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। এক. মৃতের জানাযা বিলম্ব করার হুকুম।
দুই. মৃত ব্যক্তি যে স্থানে মারা গেছে সেখান থেকে অন্যত্র নিয়ে দাফন করার হুকুম।
নিম্নে উভয় প্রশ্নের উত্তর প্রদত্ত হল।
এক. কোনো ব্যক্তি মারা গেলে শরীয়তের নির্দেশনা হল বিলম্ব না করে তাকে গোসল দিবে, কাফন পরাবে। অতপর জানাযা নামায পড়ে দ্রুত দাফন করে দিবে। একাধিক হাদীসে মৃত্যুর পর থেকে দাফন পর্যন্ত সকল কাজ দ্রুত আঞ্জাম দেওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং বিলম্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে।
যেমন, সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে, তালহা ইবনে বারা রা. অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখতে গেলেন। অতপর বললেন, আমি তালহার মধ্যে মৃত্যুর আলামত দেখতে পাচ্ছি। অতএব (সে মারা গেলে) এ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করবে। আর তোমরা দ্রুত কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করবে। কেননা কোনো মুসলমানের মৃতদেহকে পরিবারস্থ লোকদের মাঝে আটকে রাখা উচিত নয়। হাদীস : ৩১৫৯
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তোমরা তাকে আটকে রেখো না। তাকে দ্রুত দাফন করে দিও।-আলমুজামুল কাবীর, তাবারানী, হাদীস : ১৩৬১৩; ফাতহুল বারী ৩/২১৯
সুনানে ইবনে মাজাহ্য় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জানাযার জন্য লাশ উপস্থিত হলে জানাযা নামায পড়তে বিলম্ব করো না।
সহীহ বুখারীর এক হাদীসে জানাযা নামাযের পর লাশ দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বিলম্ব না করার নির্দেশ এসেছে।
যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জানাযাকে দ্রুত নিয়ে যাও। কেননা মৃত ব্যক্তি যদি নেক লোক হয় তবে তো তাকে তার শুভ পরিণতির দিকেই নিয়ে যাচ্ছ। আর যদি সে মন্দ হয় সেক্ষেত্রে তোমাদের ঘাড় থেকে আপদ সরিয়ে দিচ্ছ।-হাদীস : ১৩১৫
উল্লেখিত হাদীসের পাশাপাশি এখানে সাহাবাদের দুয়েকটি আছারও পেশ করা হল।
* আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বকর রা. মঙ্গলবার রাতে ইন্তেকাল করেন এবং সে রাতেই তাঁকে দাফন করা হয়।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১২১২৮
* উরওয়াহ রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা.-এর পরিবারের কেউ মারা গেলে তিনি বলতেন, জলদি কর, জলদি কর। তাকে নিয়ে চল, নিয়ে চল।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১২০০২
উপরোক্ত হাদীস ও আছারে মৃত্যুর পর বিলম্ব না করে কাফন, জানাযা দ্রুত সম্পন্ন করে তাড়াতাড়ি দাফন করে দেওয়ার তাকিদ করা হয়েছে।
এ সংক্রান্ত দলিলের আলোকে ফকীহগণ মৃতের গোসল, কাফন-দাফন ও জানাযা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ দ্রুত সম্পন্ন করাকে উত্তম বলেছেন এবং বিনা ওজরে বিলম্ব করাকে মাকরূহ বলেছেন।
অতএব শরীয়তের উক্ত নির্দেশনার প্রতি সকলকে যত্নবান হতে হবে।
তাই স্বাভাবিক সময়ের ভিতরে মৃতের জানাযা-দাফনের প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয়ে গেলে মৃতের ওলি উপস্থিত লোকদেরকে নিয়ে জানাযা পড়ে দ্রুত দাফন করে দিবে। এ সময়ের ভিতর কোনো আত্মীয়-স্বজন বা বিশেষ কোনো ব্যক্তির উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হলে তার জন্য বিলম্ব করা সমীচীন হবে না।
অবশ্য ওলি নিজেই যদি দূরে অবস্থান করার কারণে স্বাভাবিক সময়ের ভিতরে তার উপস্থিত হওয়া সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে ওলির জন্য উচিত তো এটাই যে, তার জন্য অপেক্ষা করতে না বলে দ্রুত দাফন করে দিতে বলবে। এতে শরীয়তের হুকুমের প্রতি যথাযথ আমল হবে।
কিন্তু ওলি যদি তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে তাহলে তার জন্য বিলম্ব করার অবকাশ রয়েছে। অবশ্য এক্ষেত্রেও এ পরিমাণ বিলম্ব করার অবকাশ নেই, যার কারণে লাশের মধ্যে পরিবর্তন হওয়ার আশংকা হয়। এত অধিক বিলম্ব করা ওলি-গায়রে ওলি কারো জন্যই জায়েয নয়।
আর দাফনে দীর্ঘ বিলম্বের উদ্দেশ্যে লাশের পরিবর্তন ও বিকৃতি রোধে লাশকে হিমাগারে রাখা, ফর্মালিন মেডিসিন ইত্যাদি পচনরোধক ঔষধ দিয়ে রাখা জায়েয নয়; বরং লাশের স্বাভাবিক অবস্থা পরিবর্তন হওয়ার পূর্বেই দাফন করে দেওয়া জরুরি। এর অধিক বিলম্ব করা গুনাহ।
এছাড়া মৃতদেহকে হিমাগারে রাখা ফর্মালিন, মেডিসিন ইত্যাদি দিয়ে রাখা সম্মানপরিপন্থী ও কষ্টদায়ক। অথচ মৃত ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, কোনো মুমিন ব্যক্তিকে তাঁর মৃত্যুর পর কষ্ট দেওয়া তেমনই যেমন জীবিত অবস্থায় তাকে কষ্ট দেওয়া।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১১৯৯০
এ সংক্রান্ত হাদীস ও আছারের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার রাহ. বলেছেন, জীবিত ব্যক্তি যে সকল বস্ত্ত দ্বারা আরাম বোধ করে মৃত ব্যক্তি তা দ্বারা আরাম বোধ করে। ইবনুল মালাক রাহ. বলেছেন, মৃত ব্যক্তি কষ্টদায়ক বস্ত্ত দ্বারা কষ্ট পায়। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৭০) তাই মৃত ব্যক্তিকে হিমাগারে রাখা মূলত তাকে কষ্ট দেওয়ারই নামান্তর। এসব কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
অনুরূপ লাশ জানাযা-দাফনের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে যাওয়ার পর সামাজিক, রাজনৈতিক বা দলীয় প্রথা পালনের উদ্দেশ্যে লাশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কর্মকান্ড করা যেমন, লাশকে স্থানে স্থানে নিয়ে প্রদর্শন করা, শ্রদ্ধা নিবেদন করা, পুষ্পস্তবক অর্পণ করা, ভিডিও করা, লাশকে সামনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে জীবনালোচনা করা, বিভিন্নমুখী ভাষণ-বক্তৃতা দেওয়া ইত্যাদি সবই গর্হিত। এগুলোর মধ্যে জীবিত মৃত কারোরই কোনো কল্যাণ নেই। এসব অনর্থক ও বেহুদা কর্মকান্ড পরহেয করা সকলের জন্য জরুরি।
আর মৃতের একাধিক জানাযা পড়া জায়েয নয়। মৃতের ওলি কিংবা তার অনুমতি সাপেক্ষে জানাযা নামায আদায় হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়বার ঐ মৃতের জানাযা পড়ার অবকাশ নেই। সাহাবায়ে কেরাম কোনো মৃতের একাধিক জানাযা পড়া থেকে বিরত থাকতেন। নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. কোনো জানাযায় পৌঁছতে পৌঁছতে জানাযা নামায শেষ হয়ে গেলে মৃতের জন্য দুআ করে ফিরে আসতেন। দ্বিতীয়বার জানাযা পড়তেন না।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৬৫৪
বিখ্যাত তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. এক মাইয়্যেতের একাধিক জানাযা পড়তে নিষেধ করেছেন।-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৬৫
এছাড়া একাধিক জানাযা পড়ার কারণে দাফনে অযথা বিলম্বও হতে থাকে। অথচ ফকীহগণ জুমার দিনের প্রারম্ভে জানাযা প্রস্ত্তত হয়ে যাওয়ার পর শুধু অধিক সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে জানাযা নামায পড়ার উদ্দেশ্যে জুমা পর্যন্ত বিলম্ব করাকেও মাকরূহ বলেছেন।
মোটকথা এসব কর্মকান্ড, রেওয়াজ-প্রথা এবং জানাযা দাফনে বিলম্ব করার প্রবণতা যতই ব্যাপক হোক না কেন তা গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয় নয়। বরং সবকিছুর উর্ধ্বে শরীয়তের হুকুমকে প্রাধান্য দিতে হবে।
জেনে রাখা দরকার, মৃতের জানাযা-দাফনে অংশ নিতে পারাটাই জীবিতদের একমাত্র কর্তব্য নয়। বরং দাফনের পরও মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের অনেক করণীয় থাকে। যেমন, মৃত ব্যক্তির জন্য দুআয়ে মাগফিরাত করা, কবর যিয়ারত করা, শরয়ী-তরীকায় ইসালে সওয়াব করা ইত্যাদি।
তাই জানাযা-দাফনে উপস্থিত হতে না পারলেও এর পরবর্তী অন্যান্য করণীয় যেমন কবর যিয়ারত ইসালে সওয়াব ইত্যাদির সুযোগ তো সব সময়ই উন্মুক্ত রয়েছে।
দুই. কোনো ব্যক্তি যে এলাকায় মারা গেছে সেখানের কবরস্থানে দাফন না করে অন্যত্র দাফন করার হুকুম।
শরীয়তের নির্দেশনা হল, কোনো ব্যক্তি যে এলাকায় মারা যাবে তাকে সেখানের কবরস্থানে বা নিকটের কোনো কবরস্থানে দাফন করে দিবে।
হাদীস শরীফে এসেছে, জাবের রা. বর্ণনা করেন, উহুদ যুদ্ধের দিন আমার ফুফু আমার পিতাকে দাফন করার জন্য নিজেদের কবরস্থানে নিয়ে আসেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করলেন, তোমরা শহীদদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত নিয়ে আস।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৭১৭
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর রা. হুবশী নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন, তাঁকে ঐ স্থান হতে মক্কায় এনে দাফন করা হয়। আয়েশা রা. হজ্ব বা উমরা করতে মক্কায় গমন করলে তিনি তাঁর কবরের নিকট আসেন অতপর বলেন, আমি তোমার মৃত্যুর সময় উপস্থিত থাকলে তোমাকে সে স্থানেই দাফন করতাম যেখানে তোমার মৃত্যু হয়েছে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১১৯৩৩
উপরোক্ত দলিলের আলোকে ফকীহগণ বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যে এলাকায় মারা যাবে তাকে সে এলাকার কবরস্থানে বা নিকটবর্তী কোনো কবরস্থানে দাফন করে দেওয়া উত্তম। ওজর ব্যতিত দূরবর্তী এলাকায় নিয়ে দাফন করা অনুত্তম।
তাই শহর বা গ্রামের মৃতকে নিজ নিজ এলাকার কবরস্থানে দাফন করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। সাধারণ অবস্থায় শহরের মৃতকে গ্রামে নিয়ে বা গ্রামের মৃতকে শহরে এনে দাফন করা ঠিক নয়। বরং এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। অবশ্য ওজরবশত মৃত ব্যক্তিকে অন্যত্র নিয়ে দাফন করাও জায়েয আছে। যেমন-
মৃত ব্যক্তি যে এলাকায় মারা গেছে সেখানে বা নিকটের কোথাও কবরস্থান বা দাফনের সুব্যবস্থা না থাকা।
এলাকার কবরস্থানে স্বাভাবিক সময় পর্যন্ত লাশ সংরক্ষিত না থাকার আশঙ্কা থাকা।
কোনো ব্যক্তির এমন স্থানে মৃত্যু হল, যেখানে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের জন্য দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা কষ্টকর।
এ ধরনের ওজরের কারণে দাফনের পূর্বে লাশ অন্যত্র নিয়ে কবরস্থ করা জায়েয আছে। কোনো কোনো সাহাবীকে মৃত্যুর স্থান হতে অন্যত্র নিয়ে দাফন করা প্রমাণিত আছে। দেখুন : আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ৫/৫৭৪
তবে ওজরবশত লাশ স্থানান্তর করার ক্ষেত্রেও নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা কর্তব্য-
স্থানান্তর ও দাফনকার্য ইত্যাদি দ্রুততার সাথে আঞ্জাম দিতে হবে।
লাশ স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে একাধিক জানাযা না হয়-সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমনটি প্রায়ই হতে দেখা যায়। কেননা মৃত ব্যক্তির একাধিক জানাযা পড়ার বিধান শরীয়তে নেই।
স্থানান্তরের কারণে এমন বিলম্ব না হতে হবে, যার কারণে লাশে পরিবর্তন আসে বা বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা হয়। এমন আশঙ্কা হলে স্থানান্তর জায়েয হবে না।
তাই প্রবাসে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তাকে সেখানেই মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করে দেওয়া কর্তব্য। কেননা, প্রবাস থেকে লাশ দেশে আনার ক্ষেত্রে অকারণেই তার দাফনে বিলম্বিত হয়।
-শরহুস সিয়ারিল কাবীর ১/২৩৬-২৩৭; মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৬১; আলবাহরুর রায়েক ২/১৯৫, ১৮০