فقيه الملةعبدالرحمن
হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর
বড় বড় বৃক্ষরাজি যেমন তপ্ত রোদে ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিককে ছায়া দেয়,তেমনি জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথে সংকটাপন্ন মানব জাতির ওপর শরয়ী চাদর দ্বারা প্রশান্তির ছায়া বিস্তৃত করেন হক্কানী ওলামায়ে কেরাম। তাইতো মহানবী হযরত মুহাম্মদ স. নবীগণের সুযোগ্য উত্তরসূরী ওলামায়ে কেরামের ইন্তিকালকে এক একটি জগতের মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন। আমরা ক্রমান্বয়ে সেরকম ঈমানদীপ্ত ওলামায়ে কেরাম ও জাতীয় মুরব্বিদের হারাচ্ছি।
গত এক যুগের মধ্যে আমরা জাতীয় খতিব আল্লামা উবাইদুল হক, আল্লামা ইসহাক গাজী, আল্লামা আলী আহমদ বোয়ালভী, আল্লামা ইসহাক ছদর সাহেব হুজুর, আল্লামা নুরুল ইসলাম কদীম, আল্লামা মুফতি আহমদুল হক, আল্লামা জমীর উদ্দিন নানুপুরী, আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী, আল্লামা আমীনুল ইসলাম, শায়খুল হাদীছ আল্লামা আজীজুল হক, জাতীয় সিপাহসালার আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমীনী, আল্লামা নুরুল ইসলাম জদীদ, আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আইয়ুব রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমূখ অবিসংবাদিত অভিভাবকদের হারিয়েছি। যাদের শূন্যতা কখনো পূরন হওয়ার নয়।
এমতাবস্থায়ও যে ক’জন প্রতিভাধর আলেমেদ্বীন নিজেদের জ্ঞানপ্রজ্ঞা, তাকওয়ার গুণাবলি, অদম্য ঈমানী স্পৃহা ও বুদ্ধিদীপ্ততা দিয়ে ঈমানী-ইসলাহী তা’লীমের পাশাপাশি জাতিকে গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দান করে আসছিলেন তাঁদের মধ্যে ফক্বীহুল মিল্লাত আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. অন্যতম। যিনি অসংখ্য ওলামায়ে কেরামের উস্তায, ঢাকা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারসহ অনেক দ্বীনি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্বব্যাপি মুসলিম উম্মাহ যখন নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত এমন ক্রান্তিকালে জাতীয় এই অভিভাবককেও আমরা হারালাম। তিনি গত ১০ নভেম্বর রাত ৭টা ৩০ মিনিটে আপন হাতে গড়া অমর কীর্তি ঢাকা বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ইন্তেকাল করেন- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বর্ষীয়ান এই আলেমে দ্বীনের ইন্তেকাল সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দেশ বিদেশে আলেম-ওলামা দ্বীনি শিক্ষার্থীসহ তাওহীদী জনগোষ্ঠীর মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া। সৃষ্টি হয় অভিভাবক হারানোর করুণ অনুভূতি। এমনকি প্রকৃতির মাঝেও বিরাজিত হয় শোকের আবহ। হুজুরের ইন্তিকালের রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিপাত, জানাযার দিনের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ তা-ই প্রমাণ করে। মরহুম হুজুরকে শেষ বারের মত এক নজরে দেখার প্রবল আগ্রহে, জানাযায় শরিক হওয়ার মহৎ উদ্দেশ্যে ঢাকা অভিমুখে নেমে আসে হাজারো শোকার্ত মানুষের স্রোত। রাজধানী ঢাকা যেন পরিণত হয়েছিল শোকের নগরীতে। শোকাহত হাজারো মানুষের গন্তব্য যেন কেবলই বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার। লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে পুরো বসুন্ধরা এলাকা। বসুন্ধরা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সম্মুখে জানাযার ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে জনস্রোতে জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ার আশংকায় বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার-৫ এর সামনে স্থান নির্ধারিত হয়। যথারীতি ১১ নভেম্বর, বুধবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে হুজুরের বড় ছেলে মাওলানা মুফতি আরশাদ রহমানীর ইমামতিতে নামাজে জানাযা বিশাল জনসমুদ্রে রূপ নেয়। জানাযার পূর্বে আলোচনা করেন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা মুফতি নুর হোসাইন কাসেমী, যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার মহা পরিচালক আল্লামা মুফতি মাহমুদুল হাসান, সাবেক মন্ত্রী মুফতি ওয়াক্কাস, ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামী, নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি এড. আব্দুর রকিব, হেফাজত নেতা আল্লামা জুনাইদ আল হাবিব, মুফতি আমিনী রহ. এর ছেলে মাওলানা আবুল হাসানাত আমীনী, ঢাকা শাইখ জাকারিয়া রহ. ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক আল্লামা মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ প্রমুখ। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এর মেয়র আনিসুল হক, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমদ আকবর সোবহান। এছাড়াও জানাযার নামাজে উপস্থিত ছিলেন, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়ার মহাপরিচালক আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বুখারী, জামিয়া আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারির মুহাদ্দিস ও হেফাজত মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী, বাবুনগর মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমীর মাওলানা মুফতি ফয়জুল করিমসহ বরেণ্য ওলামা মাশায়েখ, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। জানাযা শেষে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন দেশের বৃহত্তম মসজিদের পাশে নতুন কবরস্থানে মরহুমকে দাফন করা হয়। প্রখ্যাত এই ইসলামি ব্যক্তিত্ব আজ চির নিদ্রায় শায়িত।
প্রথিতযশা আলেমেদ্বীন ও ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ ফক্বীহুল মিল্লাত আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার ইমাম নগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম চান মিয়া।
ছাত্র জীবনে মুফতি আব্দুর রহমান রহ. নাজিরহাট বড় মাদ্রাসা ও জামিয়া আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়া-লেখা সমাপ্ত করেন। অতপর বিশ্বনন্দিত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর স্তরে কৃতিত্বের সাথে পড়া-লেখা করে ১৯৫০ সালে দাওরা হাদিস পাশ করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের ইফতা বিভাগ থেকে ফিকাহ শাস্ত্রেও গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জনপূর্বক মুফতি হিসেবে সনদ প্রাপ্ত হন। বিশ্ববিখ্যাত এই ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্রের ইফতা বিভাগ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত মুফতিগণের মধ্যে তিনি অন্যতম। যুগ-জিজ্ঞাসার শরয়ী সমাধান প্রদানে হুজুরের প্রাজ্ঞতা সব মহলে প্রশংসিত ও সমাদৃত ।
কুতবে জামান আল্লামা মুফতি আজিজুল হক রহ. এর আহবানে আল-জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে তিনি কর্ম জীবনের সূচনা করেন এবং দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের খেদমতে নিবেদিত হন। এই সময় তিনি দরস-তাদরিসের পাশাপাশি নির্বাহী শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ইসলামি শিক্ষা বিস্তার ও ঈমানি দাওয়াতের মহান লক্ষ্যে মুফতি আজিজুল হক রহ. এর পরামর্শে উত্তর বঙ্গে গমন করেন। সেখানে তিনি ওয়াজ নসিহত,আদর্শিক গুণাবলী ও গভীর প্রজ্ঞা দিয়ে ইসলামি শিক্ষা ও নৈতিকতার জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হন। ফলশ্রুতিতে বহু মসজিদ-মাদ্রাসা মক্তব ও হেফজ খানার গোড়াপত্তন করে নব দিগন্ত উন্মোচন করেন। বগুড়া জেলার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া কাছেমুল উলুমের ( জামিল মাদ্রাসা ) অগ্রযাত্রা ফক্বীহুল মিল্লাত রহ. এর নিষ্ঠাপূর্ণ প্রচেষ্টার ফসল। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের আমৃত্যু পরিচালক ছিলেন। সুদীর্ঘ ৬ বছর দাওয়াতি মেহনত শেষে ১৯৬৮ ইং সালে জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে তিনি ১৯৮৯ ইং পর্যন্ত বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দেন। তিনি একাধারে জামেয়ার প্রধান মুফতি , সহকারী মহাপরিচালক ও শিক্ষা বিভাগীয় পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি হাদিসের সর্বোচ্চ কিতাব বুখারী শরিফের পাঠদান করেন। এসময় তিনি দেশব্যাপী ১০০ সদস্য বিশিষ্ট ইফতা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯১ ইং তে তিনি রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান বসুন্ধরায় গড়ে তুলেন ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ( মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী বাংলাদেশ ) নামের উচ্চতর দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি এখন দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এ দ্বীনি এদারাকে কেন্দ্র করে একটি দৃষ্টিনন্দন জামে মসজিদও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৪ সালে বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে জামিয়াতুল আবরার নামে আরও একটি ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম শহরে জামেয়া মাদানিয়া শুলকবহর সহ দেশের প্রত্যন্ত জনপদে হুজুরের পরিচালিত ও প্রতিষ্ঠিত বহু দ্বীনি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান অমর কীর্তি হিসেবে দীপ্তিমান হয়ে আছে। তিনি এ দেশের কওমিধারার অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক, প্রধান পরিচালক ও শাখুল হাদিস হিসেবে ইসলামি শিক্ষার প্রসারে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। হুজুরের হাতে গড়া হাজারো আলেম-ওলামা দেশ-বিদেশে ইসলাম ও জাতির খেদমতে নিবেদিত আছেন।
বিশিষ্ট এ আলেমে দ্বীনের সাংগঠনিক দক্ষতাও প্রশংসনীয়। তিনি দেশের ১৮ টি উত্তরাঞ্চলীয় জেলার সহস্রাধিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত তানজিমুল মাদারীস আদদীনিয়্যাহর সভাপতি এবং বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড ফেডারশনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন মঞ্জিল অতিক্রম করে হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলি থানভী রহ. এর বিশেষ খলিফা মুহিউসসুন্নাহ আল্লামা শাহ আবরারুল হক হারদুয়ী রহ. এর খেলাফত লাভে ধন্য হন । আধ্যাত্মিকতার চর্চা ও সুন্নাতে নবভী স. অনুসরনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আকাবীরে দেওবন্দ তথা পূর্বসূরি ওলামায়ে কেরামের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. জীবন সায়াহ্নকাল পর্যন্ত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জনপদে বিচরণ করে দ্বীনি তা’লীম ও আত্মশুদ্ধির মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। বিশেষত আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলন সংস্থা বাংলাদেশের ব্যানারে দেশব্যাপী ইসলামী সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে জনসাধারনের মাঝে ঈমানী ও নৈতিক আবহ তৈরিতে হজুরের অনন্য অবদান অনস্বীকার্য। শাইখুল আরব ওয়াল আজম আল্লামা হাজ্বী মুহাম্মদ ইউনুস রহ. এর সুযোগ্য অভিভাকত্বে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থাকে সাংগঠনিক কাঠামোয় পরিচালনা ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে তিনি সুনিপুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। আজ এই ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ও সম্মেলনের প্রভাব দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি পরবর্তী সময়ে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনোনিত হন। আমৃত্যু তিনি এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।
সুন্নাতে নবভীর নিশান বরদার ফক্বিহুল মিল্লাত আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. ছিলেন শিরক-বিদআত, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ সব বাতিল তৎপরতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সোচ্চার ও সচেতন। তিনি সব বাতিল মতাদর্শ ও বহুমুখী ফিতনার বুদ্ধিবৃত্তিক মুকাবিলায় নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে আসতেন। শিরক-বিদআত নির্মূল করে তৌহিদী চেতনার উজ্জীবন এবং সুন্নাত মোতাবেক প্রাত্যহিক জীবনধারা পরিচালনার জন্য মুসলমানদের অনুপ্রাণিত করতে হুজুরের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এ বিষয়ে তিনি দ্বীনি শিক্ষার্থীদের এবং ওলামায়ে কেরামের প্রতি অধিক তাকিদারোপ করতেন। নৈতিক অধপতনের শিকার এ ক্রান্তিকালে ইয়াহইয়ায়ে সুন্নাতের সুমহান এই খেদমত মুমিনের ঈমানি শক্তিকে বিকশিত করে। আর বাতিলের ভীতকে দুর্বল করে দেয়। তাই মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি তিনি যেন ইয়াহইয়ায়ে সুন্নাতের এ ধারাকে অব্যাহত রাখেন। আমিন।
জাতির অভিভাবকতুল্য আলেমেদ্বীন আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. সুদভিত্তিক অর্থনীতির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী অবস্থানে ছিলেন। মুসলিম উম্মাহকে সুদভিত্তিক অর্থনীতি থেকে রক্ষা করা এবং ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক অর্থনীতিকে সহজ থেকে সহজ উপায়ে পরিচালনা করার মানসে বিভিন্ন কর্ম পন্থা তিনি আপন গবেষণা থেকে উপস্থাপন করেন। এ দেশে ইসলামী শরীয়া ভিত্তিক ব্যাংকিং ধারার বিকাশে যারা ভূমিকা রেখেছেন তিনি তাঁদের মধ্যে অনন্য। ইসলামী অর্থনীতির উপর হুজুরের গবেষণালব্ধ কর্মপন্থা ও সিদ্ধান্ত ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনার প্রাতিষ্ঠানিক দিক উন্মোচন করেছে। ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে হুজুরের গবেষণালব্ধ বহু কর্মপন্থা ও ফতোয়া ইসলামী ব্যাংকিং ধারাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি মুসলিম উম্মাহে সুদভিত্তিক অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে একটি শরীয়াভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় অনন্য সহায়ক হয়েছে। তিনি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের শরীয়া কাউন্সিলের প্রথম মনোনীত সদস্য। এছাড়াও তিনি আমৃত্যু আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শরীয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের শরীয়া বোর্ডের চেয়ারম্যান মনোনীত হন। দীর্ঘদিন যাবৎ সেন্ট্রাল শরীয়া বোর্ড ইসলামী ব্যাংক’স এর ভাইস চেয়ারম্যান এর পদ অলঙ্কৃত করেন। তিনি আরব বিশ্বে তথা আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার ইত্যাদি রাষ্ট্রে এবং ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে বড় বড় ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ক সেমিনারে যোগদেন। এসব সেমিনারে ইসলামী অর্থনীতির ওপর হুজুরের উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রবন্ধ খুবই সমাদৃত হয়। ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়টি এদেশে বহুল চর্চার জন্য তিনি সেন্টার ফর ইসলামিক ইকুনোমিক্স বাংলাদেশ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজ প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে তিনিই সর্বপ্রথম ২০০২ সালে ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী ব্যাংকিং বিভাগ চালু করেন। বিভাগটি তখন থেকেই ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতি বিষয়য়ে ব্যাপক খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছে। ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থনীতিকে এদেশের আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্তৃতির জন্য বেশ কয়েকবার আন্তর্জাতিক সেমিনারেরও আয়োজন করেন তিনি। হুজুরের উদ্যোগে ২০০২ ও ২০০৬ সালে ঢাকা বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে দু’টি পক্ষকালব্যাপী আন্তর্জাতিক কর্মশালা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এ কর্মশালা ও সেমিনার বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরামদের বহুদূর এগিয়ে দেয়। এ বিষয়ে তাদের উৎসাহও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এভাবে তিনি ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ধারার বিকাশে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হন। এজন্য তিনি সেন্ট্রাল শরীয়া বোর্ড ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত হয়েছেন।
দ্বীনের বহুমুখী জ্ঞানসমৃদ্ধ বরেণ্য এ আলেমে দ্বীন দরস-তাদরিস ও আত্মশুদ্ধির সুমহান খেদমতের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিতাবাদি রচনায়ও নিবিষ্ট ছিলেন। হুজুরের রচিত কিতাব সমূহের মধ্যে ‘আল-ইতিদাল ফি রুয়াতিল হিলাল’, ‘দাওয়াতুন নজর ফি তাকদিরিল মহর’, ‘ ইতিকাফে চেহেল রোজ’, ‘রা’সুল ইখতিলাফ আন আহকামিল ইতিকাফ’, ‘রাহনুমায়ে হুজ্জাজ’ ও ‘মক্কা মদীনার পথে’ উল্ল্যেখযোগ্য।
সমাজ হিতৈষী ও সংস্কারক আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান রহ. সমাজ কর্মেও এগিয়ে ছিলেন। ফক্বীহুল মিল্লাত ফাউন্ডেশন নামে একটি সেবামূলক সংস্থার মাধ্যমে তিনি অনেক সামাজিক ও সেবাধর্মী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন। এ সংস্থার মাধ্যমে দেশের গরীব মিসকিন ও এতিম ছাত্রদের সহযোগিতার ধারাও তিনি চালু করে গেছেন। এ ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় প্রতি মাসে জাতিকে শরয়ী নির্দেশনা পৌছানোর নিমিত্তে ‘মাসিক আল আবরার’ নামে একটি দাওয়া ও আত্মশুদ্ধিমুলক সাময়িকীও প্রকাশিত হয়ে আসছে। এটি হুজুরের অনবদ্য এক অবদান। যা যুগ থেকে যুগান্তরে প্রোজ্জল হয়ে থাকবে।
পারিবারিক জীবনে দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা ফক্বীহুল মিল্লাত আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান পিতা হিসেবেও সফল। তাঁর দুই ছেলে ( মুফতি আরশাদ রহমানী ও মুফতি শাহেদ রহমানী) দ্বীনি শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রিধারী।
এভাবে জীবনের পরতে পরতে তিনি সাফল্য মন্ডিত হয়েছেন, দুর্গম গ্রামে জন্ম লাভ করেও তিনি দেশ-বিদেশে খ্যাতির উচ্চ শিখরে আরোহিত হয়েছেন। এই বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীনকে অনেক বার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমি যখন রামু জামিয়াতুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র তখন একটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে হুজুর এসেছিলেন। সেবারই প্রথম দেখেছিলাম হুজুরকে। এর পর থেকে বিভিন্ন দ্বীনি জলসা, বিশেষত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে হুজুরের জ্ঞানগর্ব রুহানী বয়ান শুনার সুযোগ হয়। ফলশ্রুতিতে ক্রমান্বয়ে উনাকে উপলব্ধি করতে ও জানতে শুরু করি। আমার ছাত্র জীবনের স্মৃতিবিজড়িত ও বর্তমান কর্মস্থল ঐতিহ্যবাহী রাজারকুল আজিজুল উলুম মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় প্রায় প্রতি বছর তিনি মাদ্রাসার শুরায় ও বার্ষিক মাহফিলে আসতেন। এতে করে হুজুরকে জানার পরিধি আরো বিস্তৃত হয়। সেই সাথে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় উস্তায, মাদ্রাসার নির্বাহী পরিচালক মাওলানা মোহছেন শরিফ মুফতি সাহেব হুজুরের ঘনিষ্ঠ ছাত্র ও আস্থাভাজন হওয়াতে উনার মাধ্যমে হুজুর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় জানার সুযোগ হয়েছে। যতটুকু দেখেছি, জেনেছি, তাতে আমরা অনুভব করেছি হুজুর ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান, উন্নত রুচিশীল,স্বাতন্ত্রবোধ সম্পন্ন, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও তেজোদীপ্ত বাকশক্তির অধিকারী। সাংগঠিনক প্রজ্ঞা, নিয়ন্ত্রন দক্ষতা, গভীর চিন্তাশীলতা, অতিথি পরায়নতা, সত্য উচ্চারণে নির্ভীকতা, অসত্যের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী, ন্যায়ের পথে দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলী হুজুরের জীবনের বাঁকে বাঁকে লক্ষণীয়। কীর্তিমান এই ইসলামী ব্যক্তিত্ব আজ আমাদের মাঝে নেই। ৯৬ বছর বয়সে তিনি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চির বিদায় নিলেন। হুজুরের ইন্তিকালে জাতি হারালো ইলমে নবভীর এক উজ্জল জ্যোতিষ্ক, যোগ্য পথ প্রদর্শক ও রূহানী অভিভাবক। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে মুফতি সাহেব হুজুর রহ. এর দরজাত বুলন্দি কামনা করি। আমীন।
তথ্য সূত্রঃ
১১ ও ১২ নভেম্বর দৈনিক কালের কন্ঠ, দৈনিক ইনকিলাব ও বিডিনিউজ.কমে প্রকাশিত হুজুরের ইন্তিকাল সংবাদ। (মুফতি) মুহাম্মদ কিফায়তুল্লাহ রচিত অলিয়ে কামিল ফকীহুল মিল্লাত আল্লামা মুফতি আব্দুর রহমান সাহেব ( মুদ্দঃ আঃ) নামক নিবন্ধ,দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৫ ইংরেজী।
লেখকঃ
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ,
শিক্ষক, আজিজুল উলুম মাদ্রাসা,রাজারকুল,রামু,কক্সবাজার।
মোবাইলঃ ০১৮৩৬৭১০০৯৩