বর্তমানে নতুন নতুন পত্রিকা-দেওয়ালিকা-সাময়িকী বের
হচ্ছে, নতুন নতুন সম্ভাবনাময়ী তরুণরা লিখছে। গত কয়েক
বছরে বিশ্বাসীদের অঙ্গণে লেখকের সংখ্যা
কল্পনাতীতভাবে বেড়েছে। শহরের কথা না হয় বাদই দিলাম,
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও
হয়তো এমন কোনো মাদরাসা আজ খুঁজে
পাওয়া দুষ্কর হবে যেখানে অন্তত কয়েকজন
ছাত্র লেখালেখি করছে না। অথবা
কমপক্ষে লেখক হওয়ার অদম্য ইচ্ছা তার ভেতর
জাগছে না। আমাদের কওমী মাদরাসার
জন্য এ এক অসামান্য অর্জন।
মাদরাসার চারদেয়ালের ভেতর উর্দু-
ফার্সি-আরবির প্রচণ্ড চাপ সত্বেও
ছাত্ররা বাংলার প্রতি আগ্রহী
হচ্ছে- প্রায় প্রতি মাদরাসা থেকে এখন
বার্ষিক স্মারক-সাময়িকী-দেওয়াল পত্রিকা বের হচ্ছে-
বাংলাভাষার জন্য এ এক নতুন দিগন্তের
ঊষালগ্ন। আমরা অন্তত বুঝতে শিখেছি-
বাংলায় পণ্ডিত হওয়া ব্যতিরেকে এ ভূখণ্ডে
আমাদের আলোকিত আদর্শের জয় অনেক অন্ধকারে
হারিয়ে যাবে। প্রায় দুই দশক আগে
মুকুটহীন কলমসম্রাট, আমাদের অবিনাশী চৈতন্যের মহান বাতিঘর সাইয়েদ আবুল
হাসান আলী নদভী রহ. কিশোরগঞ্জে হৃদয়ের যে তপ্ত আহবান জানিয়েছিলেন, তা এত এত বছর
পর আমাদেরকে নাড়া দিচ্ছে- অভাগা
জাতির জন্য এ এক অমূল্য সান্তনা।
এ পৃথিবীর ইতিহাসে একই সময়ে
একইসাথে একই রকম অনেক বিষয়ের সূচনা
হয়েছে- কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে
থেকেছে মাত্র কয়েকটি। ইমাম
মালেকের মুয়াত্তা রচনার সময় আরো
কয়েকজন মুহাদ্দিস মুয়াত্তা রচনা শুরু
করেছিলেন, কিন্তু ইমাম মালেক
বলেছিলেন, যেটি আল্লাহর জন্য হবে-
কেবল সেটিই টিকে থাকবে।’ আজ এত শ শ
বছর পরও আমরা মুয়াত্তা বলতে শুধুমাত্র
‘মুয়াত্তায়ে মালিক’ বুঝি- বাকিগুলো
হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে।
ইমাম মালেক তার এ কথার মাধ্যমে যে
একনিষ্ঠ ইখলাসের কথা বলেছেন- এ
বিষয়ে আমার বলার কিছুই নেই।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লেখালেখি করতে হলে কি করতে হবে? শোন, তোমাকেই বলছি-
লেখালেখির জন্য সর্বপ্রথম এবং বিকল্পহীন
প্রয়োজনীয় বিষয় ইচ্ছা এবং
ধৈর্যশক্তি। লেখালেখির জন্য
পড়াশোনার প্রতি প্রবল
ইচ্ছা আর এ লেখালেখি অব্যাহত
রাখার জন্য প্রচন্ড ধৈর্য ছাড়া এ কণ্ঠকাকীর্ণ পিচ্ছিল পথে টিকে থাকার অন্য কোন পন্থা নেই। তোমার ভেতর
হয়তো সব গুণ ঠিকমতোই আছে-
কিন্তু এ দুটো অভ্যাস নেই- তবে তুমি
হয়তো অনেক কিছু হতে পারো- কিন্তু
লেখক নয়। এ দুটো গুণের সমন্বয়
লেখক হওয়ার জন্য শর্ত। তোমরা জানো,
শারতুশ শাই খারেজুশ শাই। শর্ত হচ্ছে
কোন বস্তুর অস্তিত্বের জন্য বহিরাবরণ
বা বাইরের প্রয়োজনীয় উপকরণ। এটা
ভেতরের অন্তর্গত বিষয় নয়।
এবার আসি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। এগুলোকে
আমরা ‘রুকনেরর’ মর্যাদা দিতে পারি। রুকনুশ শাই
দাখিলুশ শাই। রুকন হচ্ছে কোন বস্তু বা
বিষয়ের ভেতরের খুঁটি। যা দিয়ে সেটি
ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকে।
এসব প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীন বিষয়গুলোর
প্রথমটি হচ্ছে- ‘বিষয় নির্বাচন’। এ ‘বিষয়
নির্বাচনে’ দক্ষতার উপর নির্ভর করছে
লেখক হিসেবে সফলতার বিষয়টি।
সুতরাং লেখার আগে তোমার বিষয়টিকে
চারটি প্রশ্নের সামনে বিবেচনা করতে
পারো। তুমি যে বিষয়ে লিখতে চাচ্ছো,
তা কি লেখালেখির জন্য যোগ্য? এ
বিষয়ের পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাদান তোমার
জানা কিংবা তোমার হাতের নাগালে
পাওয়া যাবে তো? এ বিষয়টি কি
তোমার জন্য মানানসই বা তোমার পাঠ্য
ও কর্মক্ষেত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এ
বিষয়ে লেখার জন্য তুমি নিজেকে যোগ্য
ভাবছো তো?
এ চারটি প্রশ্নের উত্তরে যদি ‘হ্যাঁ’ হয়-
তবে এবার তুমি শুরু করতে পারো। এর
কোন একটির উত্তরে ‘না’ এলে ঐ বিষয়টি
বাদ দিয়ে অন্য বিষয় বেছে নেওয়াই
ভালো। বিষয় নির্বাচনের পর এবার ‘ধরণ’
নির্ধারণের পালা। তুমি কি সংকলন
করছো নাকি নতুন কিছু উপস্থাপনের জন্য
লিখছো?
সাধারণত যে বিষয়গুলোর জন্য মানুষ
লেখালেখি করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
কোনো একটি বিষয় সৃষ্টি বা
উদ্ভাবনের জন্য-
কোনো একটি অস্পষ্ট বিষয়কে স্পষ্ট
করার জন্য-
কোনো সুদীর্ঘ বিষয়কে সংক্ষিপ্ত
করার জন্য-
কোনো সংক্ষিপ্ত বিষয়কে
বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার জন্য-
কোনো বিষয়কে আরও গবেষণালব্ধ
করার জন্য-
কোনো এলোমেলো বিষয়কে
গোছানোর জন্য-
কোনো বিদেশি বিষয়কে অনুবাদ
করার জন্য।
তুমি এসবের মধ্য থেকে বেছে নিতে
পারো- তোমার লেখাটি ঠিক কোন
উদ্দেশ্যে রচিত হচ্ছে?
একটি বিষয় খুব ভালোভাবে মনে রেখো,
আজকাল অনেক অনেক বই প্রকাশিত
হচ্ছে- কিন্তু এগুলোর কোনটিই এ সাতটি
ধরণ বা প্রকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে
না- সেজন্য দিনদিন বইয়ের সংখ্যা
বাড়ছে অথচ মান কমছে। তোমরা হয়তো
ভাবছো- যারা নবীন লেখক তাদের জন্য
এত কঠিন উপদেশের প্রয়োজন কী? লেখা
শুরু করলেই হলো। আমি বলি, তাতে লেখা
হয়তো হবে- লেখক হওয়া হবে না। শুরু
যেভাবে- বাকি পথও সেভাবে পার হবে।
ধরা যাক, তুমি নবীজির কোনো একটি গুণ
নিয়ে লিখবে। অবশ্যই বিষয়টি প্রথম
চারটি প্রশ্নের ধাপে ‘হ্যাঁ’ উত্তর
পেয়েছে। এবার ধরণ নির্বাচন করা যাক।
যেমন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম ধৈর্যশীল মানুষ ছিলেন। এ
বিষয়ে তুমি কিছু হাদীস এবং ঘটনা তুলে
ধরতে পারো। অবশ্যই এসব কোনো না
কোনো সীরাতগ্রন্থ থেকে নিতে হবে।
তুমি হাদীস এবং সীরাত গ্রন্থ থেকে
কিছু হাদীস এবং ঘটনা পেয়ে গেলে এবং
লিখে ফেললে- এটা তো তুমি সংকলন
করলে- এমন সংকলিত লেখা ও বইয়ের তো
অভাব নেই- কিন্তু তুমি নতুন কী করলে?
তুমি যা করবে তা হলো- যেমন এ
বিষয়টিকে এ সময়ের বর্তমান
প্রেক্ষাপটে মিলিয়ে দেখো, আজকাল
সর্বত্র আমাদের স্বভাব ও হালচালকে
রাসূলের এ গুণটির সাথে তুলনা করতে
পারো। তারপর একটি ফলাফল বা
সারাংশ বের করো- এ বিষয়ে পাঠকদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করো। এ তুলনা এবং এ
থেকে একটি দৃষ্টি আকর্ষণ বা সিদ্ধান্ত-
যা তুমি বের করলে- এটিই তোমার কাজ।
এ বিষয়ে এটিই তোমার অর্জন। অন্তত
নবীন লেখক হিসেবে তোমার কাছে
এটুকুই কাম্য। শুধু কিছু বর্ণনা বা ঘটনা
একসাথে লিখে দিলে তোমার
লেখকপ্রতিভা তাতে মোটেও বিকশিত
হবে না। এতে তুমি পরনির্ভরশীল হয়ে
যাবে- নিজের ভেতর মৌলিকভাবে কিছু
লেখার সাহস হারিয়ে ফেলবে- তাই এসব
থেকে বেঁচে থাকো। পাঠকের জন্য তুমি
যে সারাংশ তৈরী করে দিলে- এখানেই
পাঠক তোমাকে খুঁজে পাবে।
পাঠকের
জন্য তোমার এ উপহার ভালো এবং
সময়োপযোগী হলে তারা তোমার লেখার
অপেক্ষায় থাকবে।
কওমী মাদরাসার ছাত্র হিসেবে যেহেতু
আমরা ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে
লেখালেখি করছি এবং এসব বিষয়ে
একমাত্র কুরআন-হাদীস-সীরাত আমাদের
প্রথম উৎস- তাই যখনই যেখানে কোন
উদ্ধৃতি তুলে ধরবো তখন আমরা অবশ্যই এর
সূত্র উল্লেখ করবো। আয়াত হলে
আয়াতের নাম্বার এবং সূরার নাম
উল্লেখ করবো। হাদীস হলে বর্ণনাকারী
এবং কিতাবের নাম উল্লেখ করবো। এ
বিষয়গুলোতে আমাদের অসচেতনতা
মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআন-হাদীসের
ছাত্র হয়েও যদি আমরা সেসবের সঠিক
নিয়মে উপস্থাপন না করতে পারি- তবে
আর ব্যর্থতা কাকে বলে?
এ কয়েকটি বিষয়ে গভীরভাবে ভাবলে
এবং মেনে চলতে পারলে লেখালেখির
এ মাধ্যমে তোমার স্বাতন্ত্র্য ফুটে
উঠবে। নিত্য নতুন বিষয়ে পড়াশোনা
এবং গবেষণার জন্য আগ্রহ জেগে
উঠবে। এখান থেকেই লেখার মান এবং
গ্রহণযোগ্যতার সূচনা। যাদের লেখা
তোমার ভালো লাগে- তুমি নিজেকেই
না হয় একটু জিজ্ঞেস করে দেখো কেন
তার লেখা তোমার ভালো লাগে?
নিশ্চয়ই তিনি এমন কিছু বিষয় লিখেন
অথবা পুরনো বিষয়গুলোই এমনভাবে
লিখেন- যা তুমি অন্য কারো লেখায়
খুঁজে পাওনা- তাই নয় কি? এখানেই তো
লেখকের সাফল্য।
আমি কি খুব বেশি উপদেশ দিয়ে
ফেললাম? বানানো উপদেশ নয়, বিশ্বাস
করো, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে পৃথিবীর
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদা
কোর্স পড়ানো হয়। আরবীতে এ কোর্সের
নাম ‘মানাহিজুল বাহস’, ইংরেজীতে বলে
‘রিসার্চ ম্যাথোলোজি’।
♣
লেখক-হাফেজ মাওলানা মুফতী রিদওয়ানুল কাদির
মুহাদ্দিস- জামিয়া ইসলামিয়া টেকনাফ, ককসবাজার।
প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়াতুল আবরার কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা।
ফাজেল- জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।