Home » কলাম » কাউকে অবজ্ঞা ও উপহাস করার পরিণতি!

কাউকে অবজ্ঞা ও উপহাস করার পরিণতি!

  • 3000+ Premium WORDPRESS Themes and Plugins
  • Download PHP Scripts, Mobile App Source Code
  • মুফতী মুহাম্মদ তক্বী উসমান দা.বা.
    অনুবাদঃ মুফতী মাহমুদ হাসান
    পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِّن قَوْمٍ عَسَىٰ أَن يَكُونُوا خَيْرًا مِّنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِّن نِّسَاءٍ عَسَىٰ أَن يَكُنَّ خَيْرًا مِّنْهُنَّ ۖ وَلَا تَلْمِزُوا أَنفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ ۖ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ ۚ وَمَن لَّمْ يَتُبْ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ [٤٩:١١]

    মুমিনগণ,কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। (সূরা হুজরাত, আয়াত-১১)

    উক্ত আয়াতে “তাসখীর”-এর অর্থ হলো, কারো অসম্মান ও তাচ্ছিল্য করা। এমনভাবে কারো দোষ বর্ণনা করা,যাতে মানুষ তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে,এতে ওই ব্যক্তির অন্তরে ব্যথা আসে। এ ধরনের কাজ অনেক রকম হতে পারে।

    যেমন,কারো চলাফেরা,উঠাবসা,কথাবর্তা,অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গ করা,কারো শারীরিক গঠন ও আকার-আকৃতি নিয়ে কটূক্তি করা তার কোনো কথা বা কাজের ওপর ঠাট্টা করা। চোখ, হাত-পা দ্বারা টিকা-টিপ্পনী মারা ইত্যাদি এ সকল জিনিস অন্তর্ভুক্ত।

    রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,“দুনিয়ায় যারা কাউকে নিয়ে উপহাস করে তাদের জন্য আখিরাতে জান্নাতের দরজা খোলা হবে এবং তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকা হবে। কিন্তু তারা যখন কাছে এসে জান্নাতের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে উদ্যত হবে তখনই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবে বারবার তাদেরকে ডাকা হবে এবং প্রবেশ করতে গেলেই তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। একপর্যায়ে এভাবে করতে করতে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে ফিরে যাবে না। এভাবে দুনিয়ায় তার উপহাসের পরিণামে আখিরাতে তাকে নিয়ে এ ধরনের উপহাস করা হবে।

    অনর্থক কথায় ইহকাল ও পরকালীন ক্ষতি:
    কিছু লোক ঠাট্টা ও উপহাসকে হাস্য-রহস্যের অন্তর্ভুক্ত মনে করে কাউকে উপহাস করে বসে,অথচ উভয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

    রসিকতা শর্ত সাপেক্ষে বৈধ,যা নবী করীম (সা.) থেকেও প্রমাণিত।
    শর্ত হলো, এতে যেন অসত্যের মিশ্রণ না হয় এবং কারো মনে কষ্টের কারণ না হয়। তাও সর্বদা ও অভ্যাসগত যেন না হয়,বরং কখনো কখনো হয়ে যাওয়া মন্দ নয়।

    কিন্তু যে উপহাস ও ঠাট্টার কারণে কারো মনে ব্যথা আসে তা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। এ ধরনের উপহাসকেও বৈধ রসিকতার অন্তর্ভুক্ত মনে করা মূর্খতা এবং গোনাহের কারণ।

    কারো উপহাস করা মুখের গোনাহের মধ্য থেকে একটি বড় গোনাহ। আমি গত মজলিসে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এ কথা বলে ছিলাম যে অনর্থক কথা, অর্থাৎ এমন কথা বলা,যা দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণকর নয় তা মানুষকে কোনো না কোনো গোনাহে নিপতিত করার উসিলা হয়ে থাকে,তা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। তা শুনে কোনো কোনো সাথী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কখনো কখনো আমরা ঘরে বিবি-বাচ্চা ও মেহমানদের সাথে বিভিন্ন কথা বলে থাকি,ওই সময় কথা না বলে একদম চুপ করে থাকাটা মেহমানের হক্ব পরিপন্থী ও অসম্মান বোঝায় তখন কী করা উচিত?
    তো ভালো করে বুঝে নেওয়া উচিত যে অনর্থক কথা বলা এক জিনিস,যাতে দ্বীন-দুনিয়া কোনোটিরই উপকার নেই এবং এর সাথে কারো হক্বও সম্পৃক্ত নয়।

    অথচ আমাদের ওপর আমাদের বিবি-বাচ্চাদের হক্ব রয়েছে, তা আদায় করাও জরুরি। ইরশাদ হয়েছে, “তোমার ওপর তোমার নফসেরও একটি হক্ব রয়েছে এবং তোমার স্ত্রীরও হক্ব রয়েছে।” এখন যদি কোনো মানুষ অনর্থক কথা থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে বিবি-বাচ্চাদের সাথেও কথা না বলে,তাহলে তাদের হক্ব নষ্ট হবে,তা কখনো জায়েয হবে না।

    অনুরূপ মেহমানের সাথে চুপ করে বসে থাকা ওই মেহমানের অধিকার হরণ হকে । মেহমানের সঙ্গে কিছু আলাপ-আলোচনা করা এবং তাকে খুশি করাও সাওয়াবের কাজ। আর তা একজন মুসলমানের প্রাপ্য। মেহমানের সম্মান করতে হবে। এর জন্য তার মন রক্ষার্থে তার সাথে কথাবার্তা বলতে হবে।
    তবে হ্যাঁ,এসব কিছুরও একটি সীমা রয়েছে,সীমাতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।

    মেহমানের হক্ব আদায়ের সীমা:
    এ কথার ওপর আমার একটি ঘটনা স্মরণ হয়েছে। তা হলো অধিকাংশ সময় কিতাবাদি মোতালাআয় ব্যস্ত থাকি,বিশেষত যখন লাইব্রেরিতে মোতালাআর জন্য বসি,গবেষণার কাজে নিমগ্ন হই,কোনো বিষয় অন্তরে এলে কলম নিয়ে তা লিখতে উদ্যত হই;ঠিক তখনই কখনো কোনো মেহমান এসে পড়ে। সে সালাম-মুসাফাহা করে কথায় লেগে যায়। তখন এতে অন্তরে একটু বিরক্তির উদ্রেক হয় এবং বোঝা মনে হয়।

    এ ব্যাপারে আমাদের হযরত শায়েখকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,ভাই! তুমি যে লেখালেখি ও পড়াশোনা করছ তা কি তোমার নফসের চাহিদা পূরণের জন্য করছ নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছ। যদি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই এগুলো করে থাকো তাহলে এ মুহূর্তে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি হচ্ছে মেহমানের সম্মান ও আপ্যায়ন করা। এটিই এ মুহূর্তের হক্ব ও অধিকার।

    যদিও তুমি আজকের দিনে এই কাজ সম্পাদনের শিডিউল করেছ,তবে যেহেতু এখন মেহমান এসে গেছে,কাজের ফাঁকে মেহমানকেও একটু সময় দেওয়া তার হক্ব এবং আল্লাহর হুকুম। সালাম-কালাম ও সংক্ষিপ্ত কথাই হোক। মেহমানকে ওই সময় পর্যাপ্ত সময় না দিতে পারলেও সংক্ষিপ্ত কথার পর পরবর্তীতে অন্য সময় দিতে পারো।

    আর যদি তোমার পড়াশোনা-লেখালেখির কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়,বরং তোমার নফসের চাহিদা পূরণার্থে হয় এবং মেহমানকে সময় দিতে কষ্ট হয়,তাহলে তা নফসের গোলামী হবে। এটি কোনো শরীয়ত নয়। যে সময় আল্লাহর যে হুকুম সে সময় তা করার নামই হলো শরীয়ত।
    হযরতের এ কথার দ্বারা আমার এ ব্যাপারে সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। অর্থাৎ মেহমানের সাথে প্রয়োজন অনুপাতে সালাক কালাম ও আলাপ-আলোচনার দ্বারা সময় নষ্ট হয় না,বরং তা মেহমানের হক্বের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ ও সন্তুষ্টির কারণ।

    তবে হ্যাঁ,মেহমানকেও আপনার সময় এবং কাজের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অযথা যেন মেজবানের সময় নষ্ট না করে। অতিরিক্ত ও অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত না হয়।

    কারো উপহাস করা উচিত নয়:
    প্রয়োজনাতিরিক্ত কথাও অনর্থক কথার অন্তুর্ভুক্ত। সাধারণ কথা থেকে টেনে শয়তান গোনাহের দিকে কখন যে নিয়ে যাবে তা টেরও পাওয়া যাবে না। আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে সিধেসাদা ও সরল প্রকৃতির। তাদেরকে নিয়ে কিছু মানুষ হাসি-তামাশা করে থাকে,সেই যেন একটা কৌতুকের বিষয় বস্তু। সে কৌতুক যদি এই পরিমাণে সীমাবদ্ধ হয় যাতে সে খুশি থাকে তাহলে তো আপত্তিকর নয়।

    তবে যদি কৌতুক ও ঠাট্টা এ পর্যায়ে পৌঁছে যায়,যা তার অন্তরে কষ্ট দেয়,তার খারাপ লাগে,তাহলে এমতাবস্থায় উক্ত কৌতুক ও রহস্য অনেক বড় গোনাহের কারণ হবে।

    কেননা তা বান্দার হক্বের সাথে সম্পৃক্ত। আর যে আয়াতটি আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম। সূরা হুজুরাতের আয়াত, যাতে আল্লাহ তাআলা মুআশারাতের দিকনির্দেশনামূলক বেশ কয়েকটি আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ করেন
    لا يسخر قوم من قوم
    “কেউ যেন কারো উপহাস না করে।”
    عسى ان يكونوا خيرا منهم
    “হতে পারে যাদেরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে তারা (আল্লাহর নিকট) তোমাদের থেকে উত্তম।”
    এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেন, ولا نساء من نساء “অনুরূপ কোনো মহিলা অপর মহিলাকে তাচ্ছিল্য করবে না।” عسى ان يكن خيرا منهن “হতে পারে তাচ্ছিল্যকৃত মহিলা তোমাদের চেয়ে আল্লাহর নিকট উত্তম।”

    কোরআনে কারীমের এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্টভাবে কাউকে নিয়ে উপহাস করতে শক্তভাবে নিষেধ করেছেন।

    এই আয়াতে মহিলাদেরকে বিশেষভাবে দ্বিতীয়বার উল্লেখ করা হয়েছে,যদিও আয়াতের প্রথম অংশের দ্বারাই মহিলা-পুরুষ সকলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। তার পরও মহিলাদের ব্যাপারটা বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ আল্লাহ তা’আলাই বেশি জানেন।
    তবে এর দুটি হিকমত বোঝা যায়।

    এক.
    সাধারণত মহিলাদের মধ্যে এ অভ্যাসটি বেশি পরিলক্ষিত হয়,তাই তাদেরকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

    দুই.
    যেহেতু পুরুষদের মজলিস ভিন্ন হবে এবং মহিলাদের মজলিস ভিন্ন হবে,তাই পৃথক পৃথক উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে যে পুরুষ-মহিলার মজলিস ও চলাফেরা ভিন্ন ভিন্ন হওয়া উচিত। আজকাল যেরূপ নারী-পুরুষের যে অবাধ মেলামেশা এ আয়াতে ইঙ্গিতে তা নিষেধ করা হয়েছে।

    কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা কবীরা গোনাহ:
    যা হোক! উক্ত আয়াতে কাউকে উপহাস করাকে সুস্পষ্ট গোনাহ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বিশেষভাবে এ কথাও বোঝানো হয়েছে যে তোমরা অন্যকে যে তাচ্ছিল্য করছ এর দ্বারা তোমরা নিজেকে বড় ও উত্তম ভেবেই অপরকে তাচ্ছিল্য করছ। এ তো চরম অহংকার যে নিজেকে উত্তম ভেবে অপরকে তুচ্ছ ভাবা হচ্ছে।

    তবে স্মরণ রেখো,আল্লাহ তা’আলা বলছেন,“ওই সহজ-সরল সিধেসাদা যে ব্যক্তিকে তুমি তাচ্ছিল্য করছ,সে আল্লাহ তা’আলার নিকট কতটুকু মর্যাদাশীল। কারো শুধু চেহারা দেখেই তো তুমি বলতে পারবে না যে আল্লাহ তা’আলার সাথে তার কতটুকু সম্পর্ক।

    প্রত্যেক বান্দার সঙ্গেই আল্লাহ তা’আলার বিশেষ একটি সম্পর্ক থাকে,এর মাঝে অনুপ্রবেশ করার কি অধিকার তোমার? তুমি কি জানো,সে আল্লাহর সাথে কী সম্পর্ক গড়ে নিয়েছে, সে আল্লাহর কত প্রিয়? কারো শুধু বাহ্যিক অবয়ব দেখেই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। কেননা মানুষ জানে না কার সাথে আল্লাহর সাথে আন্তরিকভাবে কতটুকু গভীর সম্পর্ক।

    কাউকে জাহান্নামী বলা জায়েয নেই:
    কতেক লোক কারো ব্যাপারে বলে দেয় যে সে তো জাহান্নামী,তার অমুক দোষ ইত্যাদি। নাউযুবিল্লাহ! কথাটি অনেক মারাত্মক কথা। জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা আল্লাহ তা’আলার হাতে। কাউকে এ ধরনের কথা বলা উচিত নয়।

    আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন। বাহ্যিক কাউকে খারাপ,বদকার,ফাসেক মনে হলেও হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী (রহ.)-এর পরামর্শ হলো,তার ব্যাপারে এই চিন্তা করবে যে হতে পারে আল্লাহ তা’আলা তার ভেতর এমন কোনো ভালো গুণ রেখেছেন,যার বদৌলতে তার সাথে আল্লাহর সাথে এমন মজবুত সম্পর্ক হয় যার উসিলায় তোমার চেয়ে মর্যাদায় আগে বেড়ে যাবে। আজ যদিও মন্দ মনে হচ্ছে,কাল হয়তো আল্লাহর রহমতে এমন পরিবর্তন হবে যে সবাইকে পেছনে ফেলে দেবে।

    কাউকে দেখে নিজেকে বড় মনে করা,তার থেকে নিজেকে উত্তম মনে করা এবং ওই ব্যক্তিকে ছোট মনে করাকেই তাকাব্বুর বা অহংকার বলা হয়। অহংকার মারাত্মক ক্ষতিকর একটি জিনিস।
    আল্লাহ তা’আলা দয়া করে সকল মুমিনকে তা থেকে হেফাজত করুন।

    গোনাহগারকে তাচ্ছিল্য করাও হারাম:
    এ জন্য আল্লাহ তা’আলার উক্ত ইরশাদ ব্যাপকভাবে সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য –
    عسى ان يكون خيرا منهم
    “হতে পারে ওই সব লোক তাদের থেকে উত্তম।” বাক্যটি ব্যাপক,মুত্তাকী পরহেযগার, গোনাহগার সকলেই অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ- يا يسخر قوم من قوم বাক্যটিও ব্যাপক অর্থবোধক।

    কেউ কারো উপহাস যেন না করে চাই উপহাসকারী যত বড় মুত্তাকী-পরহেযগারই হোক এবং উপহাসকৃত ব্যক্তি যত বড় ফাসেক ও গোনাহগারই হোক না কেন।

    হ্যাঁ,এটা জায়েয আছে যে অমুক ব্যক্তির এ কাজটি গোনাহের কাজ এবং তা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে। কিন্তু গোনাহের কারণে গোনাহগার ব্যক্তিকে তাচ্ছিল্য ও অপমান করা বৈধ নয়।
    কথাটি এভাবে বুঝতে পারো গোনাহগারকে মূলত অসুস্থ মনে করো। কেউ যদি কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তার ওপর দয়ার আচরণ করা হয়। তার সাথে রাগ করা যাবে না,তাচ্ছিল্য ও অপমান করা যাবে না।

    তো গোনাহগার বেচারাও একজন গোনাহের রোগী। কে বলতে পারে,হয়তো আল্লাহর নিকট তার কোনো কাজ পছন্দনীয় হয়ে আছে,যার বদৌলতে তাকে মর্যাদাবান করে দেবেন।

    এ জন্য কখনো কাউকে তাচ্ছিল্য ও উপহাস করা যাবে না। তুমি বাহ্যিকভাবে যত বড় মুত্তাকী-পরহেযগারই হও, কিন্তু হতে পারে তোমার চেয়ে ওই উপহাসকৃত ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অনেক মর্যাদাবান।

    ইঙ্গিতেও কাউকে উপহাস করা বৈধ নয়:
    কাউকে ইশারা-ইঙ্গিতে উপহাস করাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারো কথাবার্তা,চালচলন বা গঠন-প্রকৃতি নিয়ে টিকা-টিপ্পনী মারা ও হাসাহাসি করা,যার কারণে সে কষ্ট পায়,তাও হারাম।

    এক হাদীসে এসেছে,একদা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জনৈকা স্ত্রীর ব্যাপারে আলোচনা প্রসঙ্গে ঈঙ্গিতে তাঁর গঠন বেঁটে হওয়ার কথা বললেন,শুধুমাত্র হাতের ইশারায় তা বলেছিলেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তাঁকে বললেন,আয়েশা! তুমি মারাত্মক ভুল করেছ। হযরত আয়েশা (রা.)-কে কঠোরভাবে নিষেধ করলেন যেন কখনো কারো কোনো বিষয় নিয়ে তাচ্ছিল্য না করা হয়। যেরূপ সামনাসামনি কারো কোনো বিষয় নিয়ে এমন কথা বলা,যাতে ওই লোক কষ্ট পায়,তা তো মারাত্মক গোনাহ। সাথে সাথে উক্ত ঠাট্টা ও উপহাস যদি তার সামনে না করে তার অনুপস্থিতিতে করা হয় তাহলে তাতে দ্বিগুণ গোনাহ। উপহাস করার গোনাহ এবং গীবত করার গোনাহ।

    হাসি-রহস্য ও উপহাসের মাঝে বিস্তর পার্থক্য:
    কখনো কখনো বন্ধুদের মজলিসে পরস্পর হাসি-মশকরা হয়ে থাকে,যাতে এ কথা নিশ্চিত হয় যে এর দ্বারা কোনো সাথী মনে কষ্ট পায় না এবং ওই সব কথায় কেউ অপমান বোধ না করা নিশ্চিত হয় তাহলে তা বৈধ।

    কিন্তু যদি এই সম্ভাবনা থাকে যে এর দ্বারা কারো মনে কষ্ট আসতে পারে কিংবা কেউ অপমান বোধ করবে তাহলে এ ধরনের হাসি-তামাশা কখনো বৈধ হবে না।

    কারো উপহাস করার ভয়ংকর পরিণতি:
    একটি হাদীসে এসেছে,যারা অন্য কারো উপহাস করে,তারা তো এই উপহাস করে বসেই থাকে,কিন্তু তাদের পরিণাম খুবই ভয়াবহ। আখিরাতে তাদের সাথেও এ ধরনের উপহাস করা হবে। জান্নাতের দরজা খুলে তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকা হবে,কিন্তু তারা যখন এগিয়ে এসে দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবে,অমনিই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তারা ফিরে যাবে। এরপর পুণরায় দরজা খুলে তাদেরকে ডাকা হবে,আবার যেইমাত্র তারা এগিয়ে এসে ঢুকতে যাবে তখনই দরজা পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হবে। এভাবেই তার সাথে বারবার উপহাস করতে থাকবে। একপর্যায়ে সে নিরাশ হয়ে আর জান্নাতের দিকে যাবে না। এই শাস্তি এই জন্যই যে তুমি দুনিয়ায় তোমার কথাবার্তায় কাউকে উপহাস করে কষ্ট দিয়েছিলে এখন দেখো এর মজা কী রূপ।

    এ জন্যই সাবধান হওয়া উচিত,যেকোনো কথা বলার আগে মেপেজুখেচিন্তাভাবনা করেই তবে বলতে হবে।

    রহস্য ও কৌতুকের সীমারেখা:
    কেউ কেউ মানুষের উপহাস করাকে সাধারণ রহস্য ও কৌতুকের অন্তর্ভুক্ত মনে করে থাকে। অথচ উভয়ের মাঝে বিস্তর ব্যবধান।

    হাসি-রহস্য হচ্ছে ওই সব কথাবার্তা,যার দ্বারা সকলের মনে প্রফুল্লতা আসে।
    হযরত রাসূলে করীম (সা.) থেকেও তা প্রমাণিত। তবে শর্ত হলো, এ ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যা ও অসারতার আশ্রয় নেওয়া যাবে না,কাউকে অপমান করা যাবে না। তাহলে তা বৈধ।
    একটি হাদীসে এসেছে,জনৈকা বৃদ্ধা মহিলাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে যাবে না। এতদশ্রবণে বৃদ্ধা মহিলা কান্না আরম্ভ করল। তখন রাসূল (সা.) সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,আসল কথা হলো বৃদ্ধ অবস্থায় কেউই জান্নাতে যাবে না। অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশের সময় আল্লাহ তা’আলা সকলকে যৌবন অবস্থা ফিরিয়ে দেবেন।

    তো রাসূল (সা.) ওই বৃদ্ধার সাথে রহস্য করতে গিয়ে কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন,যা বৃদ্ধা বুঝতে পারেনি। তবে রাসূল (সা.)-এর কথায় অসত্যের মিশ্রণ হয়নি এবং ওই বৃদ্ধার মনে কষ্ট বা সম্ভ্রমহানিও হয়নি।

    অনুরূপ একটি হাদীসে এসেছে,জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, তোমাকে আমি একটি উটের বাচ্চা দেব তখন লোকটি বলল,হুজুর! আমি তো বাহনের উট চেয়েছি,বাচ্চা দিয়ে কী কাজ হবে? রাসূল (সা.) বললেন,বাহনের উপযুক্ত বড় উটটিও তো কোনো একটি উটনীর বাচ্চা হবে।
    সামান্য সময়ের জন্য রাসূল (সা.) লোকটির সাথে রহস্য করলেন। কিন্তু এতে কোনো অসত্যের আশ্রয় নেওয়া হয়নি এবং কাউকে কষ্টও দেওয়া হয়নি। এসব অবশ্যই বৈধ।

    তবে এমন বৈধ কৌতুকও মাঝেমধ্যে হয়ে গেলে মন্দ নয়,কিন্তু নিয়মিত এতে লিপ্ত হয়ে যাওয়াও কাম্য নয়। মাঝেমধ্যে হলে ভালো।
    তবে অবশ্যই ধর্তব্য যে এসব কৌতুক রহস্যের মধ্য দিয়ে কোনো মিথ্যার প্রচার যেন না হয়,কারো প্রতি দোষারোপ বা গীবত না হয়। সর্বোপরি কেউ যেন কষ্ট না পায়। অন্যথায় তা মারাত্মক গোনাহ হিসেবে বিবেচিত হবে।

    সারকথা হলো,সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের উঠাবসা, চলাফেরা ও কথাবার্তা লাগাতার চলতে থাকে। মুখ দিয়ে কী বের হচ্ছে এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই,এতে কি কারো মনে কষ্ট দেওয়া হয়ে যাচ্ছে কি না,তারও খবর নেই। কী হবে এর পরিণতি।

    পরিণতি সম্বন্ধে বেখবর হওয়া কখনো উচিত নয়। দুনিয়ার কাজকারবারে লিপ্ত হয়ে আখিরাতকে ভুলে যাওয়া অত্যন্ত বোকামি।
    এ কথা স্মরণ রাখা উচিত,দুনিয়া থেকে আমার চলে যেতে হবে,আল্লাহর সামনে অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। প্রতিটি কাজ ও কথার জন্য আমার জবাবদিহি করতে হবে।

    অসতর্কতা ও গাফিলতিতে আমার থেকে যেন এমন কোনো কথা ও কাজ প্রকাশ না পায়,যার ফলে আখিরাতে আমার পরিণতি খারাপ হয়। এ জন্য সর্বদা অন্তরে আল্লাহ তা’আলাকে স্মরণ রাখবে। আল্লাহর নিয়ামতসমূহের শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে।

    সকল প্রয়োজনীয়তা আল্লাহর কাছে চাওয়ার অভ্যাস করবে। সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জীবনাচরণ অধ্যায়ন করবে। যেমন-আম্বিয়ায়ে কেরাম,সাহাবায়ে কেরাম ও নেককার ওলী-বুজুর্গদের জীবনী পড়ার দ্বারাও আখিরাতের ফিকির ও আল্লাহর স্মরণ লাভ হয়ে থাকে। যেরূপ নেককার ওলী-বুজুর্গদের সংশ্রবে থাকার দ্বারা আখিরাতের ফিকির লাভ হয়, তদ্রুপ তাদের জীবনাচরণ পড়ার দ্বারাও তা অর্জিত হয়। আল্লাহর ভালোবাসাপ্রাপ্ত বান্দাদের জীবনী-কথাবার্তা অধ্যায়নের দ্বারা অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা গভীর হয়। অন্তরে ঈমান তাজা হয়,গাফিলতি দূর হয়ে আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়। এতে অযথা ও মন্দ কথাবার্তা-কাজকর্ম থেকেও মুক্ত হওয়া যায়। আল্লাহ তা’আলা নিজ দয়ায় আমাদের সকলকে এর তাওফীক দান করুন।

    সম্পর্কিত পোস্ট:


    নোটঃ কাউকে অবজ্ঞা ও উপহাস করার পরিণতি! Download করতে কোন ধরনের সমস্যা হলে আমাদেরকে জানান। যোগাযোগ করতে এখানে ক্লিক করুন।

    মীযান জামাতের সমস্ত কিতাব PDF Download

    নাহবেমীর জামাতের কিতাব PDF Download

    হেদায়াতুন নাহু জামাতের কিতাব PDF Download

    কাফিয়া জামাতের কিতাব PDF Download

    শরহে জামী জামাতের কিতাব PDF Download

    জালালাইন জামাতের কিতাব PDF Download

    মেশকাত জামাতের কিতাব PDF Download

    দাওরায়ে হাদিসের কিতাব সমূহ PDF Download

    মাদানী নেসাবের কিতাবসমূহ PDF Download

    Leave a Comment

    This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.