সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বলা হয়, কষ্টকর সময় ধীরে অতিবাহিত হয়। দুই হাজার তেরো থেকে সতেরো আমার ভীষণ কষ্টকর সময়।
একেকটা দিন, দাঁতাল বেদনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। একেকটা রাত নিকষকালো হতাশা নিয়ে আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এ চারটা বছরের কোন সূর্য আমার উঠোনে রশ্মিপাত করে নি। আসলে সূর্য ঠিকই আলো ঢেলেছে। তা আমাকে ধরা দেয় নি। হয়তো আমিই ধরি নি সূর্যের রোদ।
চিরকাল প্রকৃতি পিয়াসি আমি। উদ্ভিদ আমাকে অদ্ভুতভাবে টানে। এ চারটা বছর প্রকৃতি আমাকে আলোড়িত করে নি। আমার প্রিয় মাছরাঙাও উচ্ছ্বসিত করে নি।
জীবনানন্দ অকৃত্রিম নিসর্গজ কবি। তার কবিতাও আমাকে এ চতুষ্বর্ষ আহ্লাদিত করে নি।
এরকম বেদনাময়, একলা দুঃখময় জীবন কতো পীড়িত করেছে আমাকে? আমি ও আমার রব জানেন।
রাশিরাশি হতশ্রী হতাশার কুয়াশা মোড়ানো আমার এ বছরসম্ভার। এরকম ব্যর্থতা ক্লিশিত সময় তো সহজে ফুরায় না। আর, আমার এ নোনতা, ঘনাল বিষাদিত সময় অতিদ্রুত ফুরিয়ে গেল। এটা অবিশ্বাস্য। এরকম হয় না। আমার ক্ষেত্রে হচ্ছে।
আল্লাহর সজীব রহমত, মায়ের বরকতময় দুআ ও স্বকীয় সহজাত সঞ্জীবনী আমাকে পথ দেখিয়ে দুই হাজার আটারতে নিয়ে এসেছে। আলহামদুলিল্লাহ্। এই সময় আমি মৃত ছিলাম। কারণ, করুণ নিষ্ফলা সময়কে জীবিত বলা মিথ্যা হয়ে যায়।
কোন উপার্জন নেই।
একটি ফুলগাছ লাগাই নি। একটা ফলগাছ লাগাই নি। কোন চাষবাসহীন সময় তো অনুর্বর।
পৃথিবীর কোন কল্যাণ করি নি। নিজের সংশোধন করি নি। কারো উপকার করি নি।
কারো চোখের জল মুছি নি। কারো ঠোটে স্নিগ্ধ হাসি আঁকি নি। কারো মুঠোভরতি চাল দিয়েছি? না।
অন্তত মুঠোভরা স্বপ্ন বা সাহস? তাহলে, এতো বন্ধ্যা সময়।
মৃতের মতোও ছিলাম না। কতো পাপে পুড়েছি। শতো জনে আঘাত দিয়েছি। কারো পবিত্র মন আহত করেছি। কারো সৌন্দর্যে কদর্যতা ছিটিয়েছি।
এ জীবন মানুষের নয়, সাপের, পাপের জীবন। এ জীবন কোন পুষ্পায়ন করে নি। কোন পরাগায়ন করি নি। হায়! আফসোসও করি নি। মনস্তাপে পুড়ি নি।
কোন নতুন সিরাত পড়েছি? হয়তো পড়েছি, বুঝি নি। অনুভব করি নি।
ভাষার সমৃদ্ধকরণের চেষ্টা করি নি। নামাজে অনিয়মিত রয়ে গেলাম। নামাজের খুশু খুদু এখনো আসে নি। অপচয় ছাড়ি নি। পরচর্চা থেকে শুভচর্চায় আসতে পেরেছি? নাহ।
কুরআন কারিমের চাঁদোয়ায় জীবনী সূচনা করতে পারি নি। তাফসিরের তারকায়িত নীহারিকাপুঞ্জে সাঁতরাতে পারি নি। মরহুম আপনজনের কবর যিয়ারতে মনোযোগ ছিল? না।
পোশাকি রঙঢঙ ও প্রদর্শনীর জঙ থেকে পরিচ্ছন্ন হই নি। তাওবার সুশীল অভ্যাস আজও আয়ত্ত করতে পারি নি। অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চরম ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি করে চলেছি।
শুভ ও শোভন গুণাবলি থেকে আমি অপসৃত হচ্ছি। পাপ ও অসুন্দরে স্বাভাবিক হচ্ছি। মানবিকতা খসিয়ে যুক্তিবাদের আসকান আমার ভালো লাগছে। চাকচিক্য আমার মনন ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।
সত্য নয়, গ্রহণযোগ্যতার দাসত্বে ঠাঁই নিয়েছি। বইপুস্তক নয়, ফাস্টফুডের প্রতি আকর্ষণ বেড়েছে।
উতলা নারী আমাকে উল্লাস ও উদাস করছে। পরকালিক ভাবনা সেকেলে লাগছে? জ্বি। ইহজাগতিকতার নামে ভোগবাসনার খায়েশ হচ্ছে।
বস্তুত, আমি গত চার বসন্তে অমানুষ, নামানুষ ও ভল্লুক হয়ে গেছি।
কিছুটা অভয়ারণ্যের ভোগমত্ত প্রাণীর চরিত্রের একটা মূর্তি মানব। নীড় হারা পাখির মতো এলেবেলে ঘুরছি। ডিম ভাঙা ছানার মতো ভুল পথেঘাটে বেঘোর মরছি। আমার আসল কাজ এরকম উদ্দেশহীন ঘোরাঘুরি নয়। আমার জীবন ও মরণের মনজিল ছিল। সুখদুঃখের অর্থবল ছিল। কাজ ও চিন্তার মূল্য ছিল।
অচিন পাখি হয়ে কূলায় ভেঙেছি। বাসায় ফেরা জরুরি। এটা সম্ভব? ইনশাআল্লাহ্।
আল্লাহর তাওফিক সাহচর্য দিলে, নীড়ে ফিরব। পরের ডালে ডালে আরো কতো ভিজব? রোদেগরমে শরীরমন জ্বলে ছাইরঙা হয়ে গেছে।
ঘরে ফিরতে চাই। আমার ঘর আমি ভুলেছি। পথদ্রষ্টা, পাথেয় দাও__ পথে পথে চেরাগ জ্বালিয়ে।
রুকন রাশনান লুবান