আবদুল মুত্তালিবের পুত্র যবাহ
করার মানত
ইবন ইসহাক বলেন, যমযম খনন করার সময় কুরাইশের সঙ্গে আবদুল মুত্তালিবের যে
বিবাদ হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে তিনি মানত করেছিলেন যে যদি তার দশটি সন্তান জন্ম নেয়
এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তীকে শত্রুদের থেকে রক্ষা করার উপযুক্ত হয় , তাহলে তাদের একজনকে
কাবার নিকটে আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করবেন ৷ যখন তীর ং-ৰুম্ভান সংখ্যা দশে উপনীত হয়
এবং তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তারা র্তাকে রক্ষা করতে সমর্থ, তখন তাদের সকলকে
একত্রিত করে তিনি তার মানতের কথা অবহিত করলেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তাদের
প্রতি আহ্বান জানালেন ৷ তারা হলেন হারিছ, যুরায়র , হাজাল , যেরার, মুকাওয়িম , আবু লাহাব ,
আব্বাস, হড়ামযা, আবু তালিব ও আবদুল্লাহ ৷ পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুত্ররা বললেন,
আমরা কিভাবে আপনার এই মানত পুরণ করতে পারি ? আবদুল মুত্তালিব বললেন, তীরে নিজের
নাম লিখে আমার কাছে নিয়ে এসো ৷ পুত্ররা তা করলেন ৷ আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে কাবার
অভ্যন্তরে হোবল দেবতার মুর্তিব্ নিকট নিয়ে যান ৷
উল্লেখ্য যে, কাবার জন্য নিবেদিত উপটোকনাদি কাবা স্থিত একটি গহ্বরে রাখা হত ৷
আর হোবলের নিকট সাতটি লটারীর তীর ছিল ৷ বিশেষ কোন সমস্যা দেখা দিলে মুশরিকরা
তার নিকট গিয়ে লটারী ফেলে মীমাংসায় আসত ৷ বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই তীর থেকে যে
নিদের্শনা পাওয়া যেত, তইি তারা সর্বাম্ভকরণে মেনে নিত ৷
আবদুল মুত্তালিব পুত্রদের নিয়ে হোবলের কাছে গেলেন এবং যথারীতি লটারী তীর
তৃললেন ৷ নাম আসল আবদৃল্লাহ্র ৷ আবদুল্লাহ ছিলেন পুত্রদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এবং তার
সর্বাধিক প্রিয় ৷ আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদৃল্লাহ্র হাত ধরলেন এবং ছবি নিয়ে তাকে জবাই
করার জন্য আসাফ ও নায়েলড়া প্রতিমা দুইটির দিকে অগ্রসর হলেন ৷ তা দেখতে পেয়ে কুরাইশ
তাদের মজলিস থেকে দৌড়ে এসে বলল, আবদুল মুত্তালিব ! আপনার উদ্দেশ্য কী? আবদুল
মুত্তালিব বললেন, আমি একে জবাই করব ৷ কুরাইশ এবং আবদুল মুত্তালিবের পুত্ররা বললেন,
আল্লাহর কলম ! কোন নিশ্চিত বিকল্প না হওয়া পর্যন্ত আপনি একে জবাই করতে পারবেন না ৷
যদি তা’ করেন, তাহলে পুত্র বলি দেওয়ার ধারা চালু হয়ে যাবে ৷ তাহলে মানুষের নিরাপত্তা
কেমন করে রক্ষিত হবে ?
ইউনুস ইবন বুকায়র ইবন ইসহাক থেকে বর্ণনা করেন যে, জবাই করার জন্য যখন আবদুল
মুত্তালিব আবদুল্লাহ্কে পায়ের নীচে চেপে ধরেন, তখন আব্বাস আবদুল্লাহ্কে পিতার পদতল
থেকে টেনে সরিয়ে নেন ৷ এর কারণে আবদুল মুত্তালিব আব্বাসের মৃখমণ্ডলে এমন প্রচণ্ড আঘাত
করেন যে, মৃত্যু পর্যন্ত যে আঘাতের দাগ থেকে যায় ৷
অতঃপর কুরাইশরা আবদুল মুত্তালিবকে পরামর্শ দিল যে, হিজ্ায়ে একজন গণক ঠাকুরণী
আছে ৷ তার অনুগত জিন আছে ৷ তার কাছে গিয়ে আপনি এ বিষয়ে আলাপ করুন ৷ তারপর
সে আপনাকে যা আদেশ করে, আপনি তা-ই করুন, তাতে আমরা আপনাকে বাধা দিব না ৷
যদি সে আবদুল্লাহ্কে জবাই করতে বলে, আপনি তা-ই করতে পারবেন ৷ আর যদি
আবদুল্লাহ্কে নিঙ্কুতি দিয়ে আপনাকে অন্য কোন পরামর্শ দেয়, তবে তা-ও আপনি মেনে
নেবেন ৷
সে মতে আবদুল মুত্তালিব দল-বলসহ মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন ৷ মদীনা শহরে এসে
তিনি গণকের সাক্ষাৎ পেলেন ৷ তার নাম ছিল সাজাহ্ ৷ আবদুল মুত্তালিব তার সঙ্গে
আলাপ-আলোচনা করলেন এবং নিজের সমস্যার কথা জানালেন ৷ বিস্তারিত শুনে গণক ঠাকুরনী
বলল, আজ আপনারা ফিরে যান, আমার অনুগত জিন যখন আসবে; তখন তার কাছ থেকে
আমি এ সমস্যার সমাধান জেনে রাখব ৷ আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদের নিয়ে ফিরে গেলেন ৷ গণক
ঠাকুরণীর নিকট থেকে বের হয়ে এসে আবদুল মুত্তালিব আল্লাহ্র নিকট দোয়া করতে লাগলেন
পরদিন যথা সময়ে তারা গণক ঠাকুরণীর নিকট গিয়ে উপস্থিত হন ৷ গণক ঠাকুরণী বলল,
আপনাদের সমস্যার সমাধান আমি পেয়ে গেছি ৷ আচ্ছা, আপনাদের সমাজে মুক্তিপণের পরিমাণ
কতঃ তারা বলল, দশটি উট ৷ গণক ঠাকুরণী বলল, আপনারা দেশে ফিরে যান ৷ গিয়ে দশটি
উট নিন ৷ এই দশটি উট ও ছেলেটির মধ্যে লটারী করুন ৷ লটারীতে যদি ছেলেটির নাম আসে,
তাহলে আরও দশটি উট নিয়ে আবারো লটারী করুন ৷ আর যদি উটের নাম আসে, তাহলে
পুত্রের স্থলে উটগুলো জবাই করুন ৷ এতেই তোমাদের প্রভু সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে ধরে নেয়া
যাবে ৷ ছেলেটির জীবনও তাতে বেচে যাবে ৷
আবদুল মুত্তালিব সঙ্গীদের নিয়ে মক্কায় ফিরে আসলেন ৷ সকলের সম্মতিক্রমে লটারী শুরু
হলো ৷ আবদুল মুত্তালিব আল্লাহ্র নিকট দোয়া করতে লাগলেন ৷ দশটি উট এবং আবদুল্লাহ্কে
উপস্থিত করা হল ৷ লটারী টানা হলো ৷ নাম আসল আবদুল্লাহ্র ৷ এবার আরো দশটি উট
বাড়িয়ে লটারী দেওয়া হলো ৷ এভাবে দশটি করে উট বাড়িয়ে লটারী টানা হলো ৷ কিন্তু
প্রতিবারই আবদুল্লাহ্র নাম উঠতে লাগল ৷ অবশেষে একশত উট আর আবদুল্লাহ্র মধ্যে লটারী
দেওয়া হলে উটের নাম উঠলো ৷ আবদুল মুত্তালিব তখন হোবলের নিকট দীড়িয়ে আল্পাহ্র
কাছে দোয়া ৰু করছিলেন ৷ কুরাইশের লোকেরা র্তাকে বলল, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে ৷
আল্লাহ আপনার প্রতি সভৃষ্ট হয়েছেন ৷ কিন্তু আবদুল মুত্তালিব বললেন, না, এতে হবে না ৷
আরো তিনবার লটারী না করে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না ৷ অগত্যা লোকেরা আরো তিনবার
লটারী দিল ৷ প্রতিবারই উটের নাম আসল ৷ এবার উটগুলাে জবাই করা হলো আর আবদুল্লাহ
বেচে গেলেন ৷
এক বর্ণনায় আছে যে, উটের সংখ্যা একশ’তে পৌছার পরও আবদৃল্লাহর নাম আসে ৷
তখন আরো একশত বাড়িয়ে লটারী দেওয়া হয় ৷ এবারও আবদুল্পাহ্র নাম আসলে উট আরো
একশত বাড়ানো হয় ৷ এভাবে তিনশত উট আর আবদুল্লাহর মাঝে লটারী দেওয়ার পর উটের
নাম আসে ৷ তখন গিয়ে আবদুল মুত্তালিব উটগুলো জবাই করেন ৷ তবে প্রথম বর্ণনাটিই
বিশুদ্ধতর ৷ আল্লাহই ভাল জানেন ৷
এক বর্ণনায় আছে যে, জনৈক মহিলা ইবন আব্বাস (রা)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে
যে, সে মানত করেছিল কাবার নিকটে তার একটি সন্তান বলি দেবে ৷ এখন তার করণীয় কী?
জবাবে ইবন আব্বাস (মা) তাকে একশত উট জবাই করার আদেশ দেন এবং মহিলাকে
আবদুল মুত্তালিবের ঘটনাটি গুলিয়ে দেন ৷ আবার মহিলা আবদুল্লাহ্ ইবন্ উমর (রা)-কে
সমস্যাটির কথা জানালে তিনি কোন সিদ্ধান্ত দানে বিরত থাকেন ৷ মারওয়ান ইবন হাকাম তখ্যা
মদীনায় গভর্নর ৷ তিনি সংবাদ শুনে বললেন দুজনের একজনের সিদ্ধাম্ভও সঠিক হয়নি ৷
অতঃপর তিনি মহিলাকে পুত্র জবাই করতে নিষেধ করে দিয়ে তার সাধ্যমত সৎকাজ করতে
আদেশ দেন ৷ উট জবাই করার আদেশ তিনি দিলেন না ৷ পরে এরুপ সমস্যায় মানুষ
মারওয়ানের ফয়সালা অনুযায়ীই আমল করতে শুরু করে ৷
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (২য় খণ্ড) ৫৯-
আমিনা বিনতে ওহব যুহরিয়ার সঙ্গে পুত্র
আবদুল্লাহর বিবাহ
ইবন ইসহাক বলেন, ঐতিহাসিকদের মতে, অতঃপর আবদুল মুত্তালিব পুত্র আবদুল্লাহর
হাত ধরে বনু আসাদ ইবন আবদুল উযয৷ ইবন কুস৷ই এর এক মহিলার নিকট গমন করেন ৷
মহিলাটি হলো ওয়ারাকা ইবন নওফলের বোন ৷ তার নাম ছিল উম্মে কিতাল ৷ সে সময়ে সে
কা ‘বার নিকট অবস্থান করছিল ৷ আবদুল্লাহ্কে দেখে সে বলল, আবদুল্লাহ ৷ তুমি যাচ্ছ কোথায় ?
আবদুল্লাহ বললেন, আমি আমার আব্বার সঙ্গে যাচ্ছি ৷ মহিলাটি বলল, যদি তুমি এই মুহুর্তে
আমার সাথে মিলিত হতে সম্মত হও তা হলে আমি তোমার বদলে যে সংখ্যক উট জবাই করা
হয়েছে, সে সংখ্যক উট তোমাকে দেব ৷ জবাবে আবদুল্লাহ বললেন, আমি আমার আব্বার সঙ্গে
আছি ৷ তাকে ছেড়ে অন্যত্র যাওয়া বা তার মতের বাইরে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ৷
আবদুল্লাহ্কে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব ওহব ইবন আবদে মানাফ , ইবন যুহরা ইবন কিলাব ইবন
মুররা ইবন কাব ইবনে লুওয়াই ইবন গালিব ইবন ফিহর এর নিকট যান ৷ ওহব ইবন আবদে
মানাফ তখন বয়স ও মযদািয় বনু যুহরার সর্দার ছিলেন ৷ আলাপ আলোচনার পর তার কন্যা
আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহর বিবাহ হয়ে যায় ৷ আমিনাও ছিলেন তার সম্প্রদায়ের মহিলাদের
নেত্রী ৷ ঐতিহাসিকদের মতে বাড়িতে নিয়ে আসার পর আমিনার সঙ্গে আবদুল্লাহর বাসর হয় ৷
তাতে রাসুলুল্লাহ (সা) তার গর্ভে আসেন ৷
অতঃপর আবদুল্লাহ পুনরায় বনু আমাদের উল্লিখিত মহিলার নিকট যান ৷ কিন্তু মহিলাটি
এবার তাকে কিছুই বলল না ৷ আবদুল্লাহ বললেন, কী ব্যাপার, আজ যে কোন প্রস্তাবই করছ না,
যেমনটি গতকাল করেছিলাে মহিলাটি বলল, গতকাল তোমার সঙ্গে যে নুর ছিল , এখন আর তা
নেই ৷ তোমাকে এখন আর আমার প্রয়োজন নেই ৷ উল্লেখ্য যে, এই মহিলা তার ভাই ওয়ারাকা
ইবন নওফলের নিকট গুনেছিল যে, এই উম্মতের মধ্যে একজন নবী আগমন করবেন ৷ তাই
তার আকাত্তখা ছিল যে, সেই নবী তারই গর্ভ থেকে জন্মলাভ করুন ৷ কিন্তু আল্লাহ তাকে
সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত ও পবিত্র বংশে প্রেরণ করেছেন ৷, যেমন , এক আয়াতে আল্লাহ তা ‘ আলা
বলেছেন :
“আল্লাহ রিসালাতের ভার কার উপর অর্পণ করবেন, তা তিনিই ভাল জানেন ৷”
(৬ : ১২৪ )
রাসুলুল্লাহ (না)-এর জন্মের বিস্তারিত কাহিনী পরে আলোচনা করা হবে ৷
উম্মে কিতাল বিনতে নওফল তার ব্যর্থতার জন্যে অনুতাপ প্রকাশ করতে গিয়ে নিম্নোক্ত
পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেছিলেন ৷ ইবন ইসহাক সুত্রে বর্ণিত বায়হাকীর বর্ণনা থেকে তার প্রমাণ
পাওয়া যায়