আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: তোমাদের উপার্জিত উত্তম বা পবিত্র সম্পদ থেকে খরচ কর। (সূরা বাকার:২৬৮) ছোট একটি আয়াত, কিন্তু এর মর্ম অনেক। কেননা এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, উপার্জন পবিত্র-অপবিত্র দু‘টোই হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াতে মানবজীবনে আয়ের মাধ্যম ও ব্যয়ের ক্ষেত্র সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। যা প্রতিটি মানুষেরই প্রয়োজন। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: হে নবীগণ! আপনারা উত্তম (হালাল) মাল থেকে আহার করুন এবং নেক আমল করুন। (সূরা মুমিন:৫১)
এ আয়াতেও আল্লাহ তা‘আলা দু‘টি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। ১. হালাল আহার করা। ২. নেক আমল করা। মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করা। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা সেই মূল উদ্দেশ্যকে উল্লেখ না করে ‘হালাল ভক্ষণ করা’কে আগে উল্লেখ করেছেন। কারণ একজন মানুষ বেঁচে থাকা এবং তার ইবাদত করার মত শক্তি সঞ্চয় করার মাধ্যম হলো আহার গ্রহণ। সুতরাং বাঁচার জন্য যেমন আহারের প্রয়োজন তেমনি ইবাদতের জন্যও আহারের প্রয়োজন। তবে পার্থক্য হলো, বাঁচার সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে আর ইবাদত-বন্দিগীর সম্পর্ক আখেরাতের সাথে। দুনিয়ায় যেহেতু ভাল-মন্দ, হালাল-হারাম সব কিছুই আছে, তাই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য যে আহারের প্রয়োজন তা যেমন মানুষ গ্রহণ করে তেমনি অন্যান্য জীব-জন্তুও গ্রহণ করে, তা যেমন মুমিন-মুসলমানরা গ্রহণ করে তেমনি কাফির-মুশরিকরাও গ্রহণ করে। সুতরাং এটা নিয়ে আলাদাভাবে কোনো আলোচনার কিছু নেই এবং কোনো নীতিমালারও প্রয়োজন নেই। তাই বাঁচার তাগিদে এখানে মানুষ ও চতুষ্পদ জন্তু সবই সমান। কিন্তু যে আহার গ্রহণ করা হয় আখেরাতের জন্য, ইবাদত-বন্দেগীর শক্তি সঞ্চয় করার জন্য তা অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুযায়ী হতে হবে। কারণ আখেরাত হলো পাক-পবিত্র। তাই সেখানের কাজ-কর্ম ইবাদত-বন্দেগীও হতে হবে পাক-পবিত্র অবস্থায়। অন্যথায় তা বৃথা যাবে। যেমন মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন ; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : আল্লাহ তা‘আলা উত্তম এবং তিনি উত্তম ছাড়া কবুল করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী-রাসূলদেরকে যে সব বিষয়ে আদেশ করেছেন মুমিনদেরকেও সে বিষয়েই আদেশ করেছেন। (এর পর কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করেছেন) প্রথম আয়াত হলো যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হে নবীগণ! আপনারা উত্তম (হালাল) মাল থেকে আহার করুন এবং নেক আমল করুন’। (সূরা মুমিন:৫১) অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘হে ঈমানদাররা ! তোমরা ঐসব উত্তম বস্তু আহার কর যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর। যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। ( সূরা বাকারা:১৭২) এই হাদিস থেকেও বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা উত্তম বা হালাল মাল ভক্ষণ করতে বলেছেন। সুতরাং হালাল মাল ভক্ষণ করা ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা ইবাদত-বন্দেগী কবুল করবেন না। তাই আল্লাহ তা‘আলা আয়াতের প্রথমাংশে হালাল আহার গ্রহণ করতে বলেছেন।
আয়াতের দ্বিতীয়াংশে আল্লাহ তা‘আলা নেক আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা হালাল উপার্জন আমলের ওপর অগ্রবর্তী এবং হালাল আহার গ্রহণ করার ফলাফল হচ্ছে সততা ও তাকওয়া-পরহেযগারী। অর্থাৎ যে ব্যক্তি হালাল আহার গ্রহণ করবে তার মাঝে আল্লাহর ভয়, আখেরাতের চিন্তা ও সততা আসবে ও নেক আমলের তাওফিক হবে এবং তার দু‘আ কবুল হবে। অন্যথায় নেক আমল অনেক করবে কিন্তু তার কোনো লাভ হবেনা এবং তার দু‘আও কবুল হবেনা। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : কিছু মানুষ ধুলো-মলিন অবস্থায় দীর্ঘ সফর করে (ইলমের জন্য বা দা‘ওয়াতের জন্য বা হজ্জের জন্য বা অন্য কোনো দীনী কাজের জন্য) আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে হাত তোলে দু‘আ করে। (কেননা আল্লাহ তা‘আলা মুসাফিরের দু‘আ কবুল করেন) কিন্তু তাদের দু‘আ কীভাবে কবুল হবে। (অর্থাৎ তাদের দু‘আ কবুল হয় না। যদিও তারা দীনের জন্য সফর করছে) কেননা তাদের খাবার-দাবার হারাম, তাদের পোশাক-আশাক হারাম। (মুসলিম শরীফ২৩৯৩)। এ হাদিস থেকেও বুঝা গেল, হালাল খাওয়া এবং হালাল পরা ছাড়া আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলে দু‘আও কবুল হয়না। যার কারণে দেখা যায় বর্তমানে মানুষ হারাম মাল খাচ্ছে এবং আপন উদ্দেশ্যের জন্য নিজে দু‘আ করছে আবার কখনো হারাম মাল দিয়ে অন্যকে দিয়ে দু‘আ করাচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই কোনো কাজে আসছে না। তাই যে কোনো ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম শর্ত হলো হালাল খাওয়া। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
আর যে ব্যক্তি হালাল-হারাম তমিয করেনা, হারামে সবসময় লিপ্ত থাকে তার মাঝে আল্লাহর ভয়, আখেরাতের চিন্তা ও সততা সৃষ্টি হবে না। বরং সে হবে অর্থ লিপ্সু, স্বার্থপর ও ধোকাবাজ। সর্বশেষ তার স্থান হবে জাহান্নাম। কেননা হাদিস শরিফে এসেছে : এমন শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না যা হারাম দ্বারা গড়ে উঠেছে, আর যে সকল শরীর হারাম দ্বারা গড়ে উঠে তা জাহান্নামের জন্য অধিক উপযোগী। (মিশকাত শরীফ)। সুতরাং ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য, নেক আমলের তাওফিক লাভ করার জন্য সর্বোপরি-জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে আল্লাহ তা‘আলার চিরসন্তুষ্টির স্থান জান্নাত লাভ করার জন্য সর্বপ্রথম মাধ্যম হলো হালাল উপার্জন ও হালাল আহার গ্রহণ করা।
মানুষ যা উপার্জন করে সেটা হয়ত দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত বা আখেরাতের সাথে। সূরা বাকারার ২৬৮ আয়াতের প্রথামাংশে আখেরাতের উপার্জন (দান-সদকা) সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয়াংশে দুনিয়ার উপার্জন (মাল-সম্পদ) সম্পর্কে বলা হয়েছে। বাহ্যিকভাবে যদিও আখেরাতের কথাকে অগ্রবর্তী বলে মনে হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে তা নয়। কেননা উপার্জিত সম্পদ থেকে খরচ করতে হলে আগে উপার্জন করতে হবে। সুতরাং আগে উপার্জন তারপর খরচ। যদি উপার্জনই না করা যায় তাহলে খরচ কীভাবে করবে?
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা উত্তম উপার্জন থেকে খরচ করতে বলেছেন। সুতরাং এখন জানার বিষয় হলো উত্তম উপার্জন কাকে বলে ? শরিয়তের দৃষ্টিতে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মূলনীতি হলো দু‘টি- ১. যা উপার্জন করা হবে তা মৌলিকভাবে হালাল হতে হবে। ২. যা উপার্জন করা হবে তা বৈধ পন্থায় করতে হবে । সুতরাং উপার্জন ও অর্জিত সম্পদ দু‘টোই কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে বৈধ হতে হবে। মোট কথা যেখানেই আল্লাহর নির্দেশিত কোনো পন্থা পাওয়া যাবে সেটাই হবে বৈধ উপার্জন। শরিয়তের দৃষ্টিতে মানুষ বৈধ পন্থায় যে সকল মাল উপার্জন করে তাই হলো উত্তম বা পবিত্র। তা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন : হাতের কাজ, ব্যবসা, ভাড়া, হিবা-দান, উত্তরাধিকার ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে ব্যবসা হলো উত্তম উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। তাই তো আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, আল্লাহ তা‘আলা সুদকে কেন হারাম করলেন আর ব্যবসাকে কেন হালাল করলেন ? অথচ ব্যবসা তো দেখতে সুদের মতই। যেমনটি বলেছিল মক্কার কাফেররা।
প্রথমত: একথা বুঝার আগে আমাদের এ আক্বিদা-বিশ্বাসকে অবশ্যই দৃঢ় করতে হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা ‘হাকীম’ বা প্রজ্ঞাময়, তার কোনো কাজ বা কথা কখনোই ‘হিকমত’ বা প্রজ্ঞা থেকে খালি হতে পারে না। সুতরাং তিনি যা বলেছেন তাই সত্য এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর। এর বাইরে কেউ যদি মানব রচিত কোনো মনগড়া নীতিমালা আমাদের সামনে পেশ করে আমি একজন মুসলামান হিসেবে কখনোই সেটাকে মেনে নিতে পারিনা, এমনকি সমর্থনও করতে পারি না। তাই মক্কার কাফিরদের সেই উক্তি ‘ব্যবসা তো সুদের মতই’ এধরনের কোন যুক্তি ছাড়াই আমরা বিশ্বাস করি সুদ হারাম আর ব্যবসা হালাল। আর এটাই হলো প্রকৃত ঈমানের দাবি।
দ্বিতীয়ত: ব্যবসা মানবজীবনে উন্নতি বয়ে আনে, আর সুদ আনে অবনতি। ব্যবসায়ীরা হলো মানবতার বন্ধু আর সুদখোররা হলো মানবতার দুশমন। তাই তো দেখা যায় দেশে কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে ব্যবসায়ীদের অবস্থার অবনতি আর সুদখোরদের হয় উন্নতি। কারণ একজন ব্যবসায়ী চাইবে দেশের উন্নতি হোক, সব মানুষ টাকা-পয়সাওয়ালা হয়ে যাক, তাহলে তাদের ব্যবসা ভালো হবে। আর একজন সুদখোর চাইবে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেক, আর জনগণ তাদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণ করুক, তাহলে তাদের অবস্থার উন্নতি হবে, তারা লাভবান হবে। এই একটি মাত্র উদাহরণের মাধ্যমেই বুঝা যায় ব্যবসায়ীরা হলো মানবতার বন্ধু আর সুদখোররা হলো মানবতার দুশমন। তাই তো আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসাকে করেছেন হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন এবং সুদখোরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অপর দিকে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৎ ও আমানদার ব্যবসায়ীর জন্য- নবি, সিদ্দিকীন, শহিদ ও সৎ বান্দাদের সাহচর্যের পুরস্কারের কথা বলেছেন। সুতরাং যে সম্পদ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত হবে তা হলো হালাল ও বরকতময়; এতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু ব্যবসাকে বরকতময় করার জন্য অবশ্যই কিছু নীতিমালার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে যেমন:
১. ক্রয়-বিক্রয় সঠিক হওয়ার শর্র্তাবলির দিকে খেয়াল রাখা।
২. মাকরুহ বা অপছন্দনীয় ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বিরত থাকা।
৩. এমন কোনো জিনিস তৈরি করা বা বিক্রি করা থেকে বিরত থাকা যার ক্রেতা সাধারণত ফাসেক, পাপাচার অথবা কাফের বা অহংকারী নেতৃবর্গ বা জালিম রাজা-বাদশা হয়। কারণ এমন লোকদের নৈকট্য আল্লাহ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করে অথবা তাদের অধিকাংশ মাল বিপদের কারণ (অর্থাৎ হারাম বা সন্দেহযুক্ত)
৪. পণ্য এমন না হওয়া যা মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদে জায়েজ হয়। যেমন আফিম, বিষ ইত্যাদি।
৫. বাতিল আকিদা-বিশ্বাসের বই-পুস্তক বিক্রি করা থেকে বিরত থাকা। অর্থাৎ- যে সমস্ত বই-পুস্তকে গুনাহ বা অশ্লীলতার গল্প-কাহিনী রয়েছে বা শরিয়ত বিরোধী বিষয়সমূহ লেখা হয় এগুলো পরিহার করা।
এসব বিষয় সামনে রেখে যদি আমরা ব্যবসা করতে পারি তা হলে তা হতে পারে আমাদের জীবীকা নির্বাহের এক বরকতময় মাধ্যম।