কুর-আনুল কারিম আল্লাহর কালাম। আল্লাহ মানে তামাম জাহানের প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা ও মহান প্রভু। কুরআন মাজিদ রবের কথা। তিনি মানবজাতির প্রতি তাঁর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত চিরকুট হিসেবে কুরআন কারিম অবতীর্ণ করেছেন।
আল-কুরআন অনেক অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সাজানো। একশত চৌদ্দ সুরা নিয়ে কুরআনুল কারিম সুগঠিত। সুরা হল কুরআনিক পরিচ্ছেদ। কুরআনের পরিভাষায় অধ্যায়কে সুরা নামে অভিহিত করা হয়। একেক সুরার একেক রকম নাম। প্রতি সুরায় মৌলিক বিষয় এক হলেও আলাদা আলাদা বিষয়ান্তর নিয়ে আলাপ হয়েছে। একেক সুরার একেক রস, একেক রঙ, একেক স্বাদ, একেক সুধা ও একেক সুঘ্রাণ।
কুরআনের ধারাক্রমে সুরাতুল ফাতিহা এক নাম্বার সুরা। সুরাতুল ফাতিহা মক্কী সুরা। অর্থাৎ মক্কা শরিফে হিজরতের আগে অবতীর্ণ হয়েছে। ফাতিহা অবতরণানুযায়ী পাঁচ নাম্বার সুরা। বিন্যাস অনুযায়ী এক নাম্বার। কুরআন অবতরণ মাফিক বিন্যাস্ত হয় নি। আল্লাহর নির্দেশ মতো ধারাক্রম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সন্নিবেশিত করেছেন। যেমনটি কুরআনের সুরাগুচ্ছ পুরোটা একসাথে নাজিল হয় নি। বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ অনুযায়ী আয়াত তথা কুরআনিক পংক্তি নাজিল হত। আল্লাহর ঘোষণা মতো তা বিবিধ সুরার সাথে সংযুক্ত হত। এটা কুরআনিক পদ্ধতি।
সুরাতুল ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন বলা হয়। কুরআন জননী তথা কুরআনের মূল। মূলতঃ কুরআন কারিমের বিষয়াদির সারাৎসার সুরাতুল ফাতিহার মাঝে সন্নিবেশিত।
ফাতিহা মানে ভূমিকা। সূচনা বক্তব্যের মতো এই সুরা কুরআনের বিষয়াবলীর মৌলিক ইঙ্গিত ও বাস্তবিক ইশারা দিয়ে ফেলেছে।
মাত্র সাত আয়াতের এই ক্ষুদে সুরা প্রতিদিন আমরা কমপক্ষে সতেরো বার তিলাওয়াত করি। কুরআনের পঠনকে তিলাওয়াত বলা হয়। কুরআন বিশেষভাবে পড়তে হয়, তাই তিলাওয়াত নামকরণ করা হয়েছে।
এই সুরাকে কাফিয়া বলা হয়। কাফিয়া মানে যথেষ্ট। শাফিয়া বলা হয়। শাফিয়া মানে আরোগ্যকারি। মাসানি বলা হয়। মাসানি মানে পুনরাবৃত্ত। আরো অজস্র নাম আছে এই মিষ্টি সুরার।
এই সুরার মূল বিষয় হল-ইবাদতের পরিচয় ও পরিসর।
কুরআন মূলতঃ তিন বিষয়আশয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে।
এক
আকায়েদ। বিশ্বাস বিষয়ক আলাপ।
দুই
ইবাদাত। পূজা অর্চনাগুচ্ছক।
তিন
মানহাজুল হায়াত। জীবনযাপনের পদ্ধতি।
এই সুরায় উপরে আলোচিত সব বিষয় মিলমিশ করে আছে।
কুরআন প্রথমে বিশুদ্ধ বিশ্বাসের কথা বলে। একক স্রষ্টার গল্প বলে। একমাত্র প্রতিপালকের পরিচয় দেয়।
সুরার শুরতে রবের প্রশংসা করা হয়- আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আ-লামীন। তাঁর গুণকীর্তন গাওয়া হয়- আর-রহমানির রহিম।
বিশ্বাসের চূড়া পুনরুত্থান ও পরকালিন প্রতীতিকে পরিষ্কার করা হয়- মালিকি ইয়াউমিদ্দীন।
তারপর ইবাদতের পরিচিতি তুলে ধরা হয়। মা’বুদের আলাপ আসে। তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনাকে সীমায়িত করা হয়- ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন।
তারপর, মানহাজুল হায়াত তথা জীবনপথ স্বচ্ছ করে বলা হয়। সিরাতে মুস্তাকিম তথা সরল ও সবল পথের দুআ করা হয়- ইহদিনাস-সিরাতাল মুস্তাকিম।
সিরাতে মুস্তাকিমকে সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়া হয়। আশীর্বাদ ও ভালোবাসাপুষ্ট ও সন্তুষ্ট কাফেলার কথা বিবৃত হয়- সিরাতাল্লাযীনা আনআমতা আলাইহিম। তারপর, বিকল্প বিতাড়িত ও অভিশপ্ত জীবনপথ থেকে পানাহ চাওয়ার দুআ হয়- গইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়া-লাদ্দ-ল্লীন।
পুরো সুরা একটা নিটোল দুআ। দুআর পরতে পরতে ইবাদতের মৌলিক বিষয় এসে গেছে।
আকায়েদের মূল সম্যকভাবে এসে গেছে। আল্লাহর পরিচয় এসে গেছে। আল্লাহর নামবাচক শব্দ আলোড়িত করল আমাদের।
মহা-বিশ্বের প্রতিপালনের মতো বিস্তৃত বিষয় ঝিলিক মেরে গেল। পৃথিবীর ইতিহাসের শুভ ও অশুভের ফারাক, পরিচয় বর্ণিত হল। এবং আমাদের কাঙ্ক্ষিত ও প্রার্থিত পথপাথেয় আলোচিত হল।
মূলত: আল-কুরআনের মহা সামুদ্রিক প্রজ্ঞা কলরোলের একটা পেলব তরঙ্গ যেন সুরাতুল ফাতিহা।
আল-কুরআন শুধু মুসলমানের গ্রন্থ নয়। এটা মহা-বিশ্বের সকল জীন ও মানুষজনের প্রতি মহান রবের শেষ ও শ্রেষ্ঠ চিঠি।
এটা পড়া, বুঝা ও অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। আপনি ও আমি কি এ শেষ বার্তা পড়ার প্রয়াস পাই?
শেষ বার্তা উপলব্ধির সুযোগ হয়?
হওয়া জরুরি।
পুরো কুরআনের অর্থ, তিলাওয়াত ও তাফসির পড়ার সময় না হলে, আপনি ও আমি দুর্ভাগা। শয়তান আমাদের সৌভাগ্য গিলে ফেলছে।
শয়তানি ওয়াসওয়াসা থেকে পালিয়ে কুরআন নিয়ে বসুন। জীবনপথ ও মননরথ পাল্টে যাবে। জীবনদর্শন ও স্বপনদর্পন বদলে যাবে।
সুরা ফাতিহা নিয়ে হাজার হাজার, হা জা র তাফসির ও বিশ্লেষণ লিখিত হয়েছে। আরো লক্ষ হচ্ছে ও হবে। এ তো অনিঃশেষ ও অতুলনীয় অতলান্তিক প্রস্রবণধারা ও ঝারা।
আপনিও কুরআনের কুহুতানে সময়যাপন করুন। নতুন কোন তাফসির ও মজাদার বিশ্লেষণে আমাদের আমোদিত করুন। নতুবা নবনব মুক্তোদানার সুষমা চোখে মুখে মাখুন।
(রুকন রাশনান লুবান)