অর্থাৎ—- সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর যিনি আদি-অন্ত, ব্যক্ত ও গুপ্ত এবং যিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত ৷ তিনি আদি, তাই তাঁর আগে কিছু নেই ৷ তিনি অস্ত, তাই তাঁর পরে কিছু নেই ৷ তিনি ব্যক্ত, তাই তাঁর উপরে কিছু নেই ৷ তিনি গুপ্ত, তাই তাঁর পেছনে কিছু নেই ৷ তিনি আপন কামালিয়াতের যাবতীয় গুণাবলী অনাদি সহ অনন্ত, অক্ষয় , অব্যয় , চিরন্তন সত্তা ৷ আঁধার রাতে নিরেট পাথরের উপর কালো পিঁপড়ের পদচারণা এবং ক্ষুদ্র বালু-কণার সংখ্যা সম্পৃর্কেও তিনি সম্যক অবহিত ৷ তিনি উন্নত, মহান ও মহিমান্বিত ৷ তিনি মহা উন্নত ৷ সব কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন নিখুঁত পরিকল্পনা অনুসারে ৷
আকাশমণ্ডলীকে তিনি উর্ধ্বদেশে স্থাপন করেছেন স্তম্ভ ছাড়াই এবং সেগুলোকে সুশোভিত করেছেন উজ্জ্বল নক্ষত্রমালা দ্বারা, তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ্ত সুর্য এবং জ্যোতির্ময় চন্দ্র এবং তার উপরে তৈরি করেছেন সুউচ্চ, প্রশস্ত ও গোলাকার সিংহাসন ৷ তাহলো মহান আরশ ৷ যার আছে বিরাট বিরাট স্তম্ভ যা বহন করেন সম্মানিত ফেরেশতাগণ, যা ঘিরে আছেন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ, তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক ৷ আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা গাওয়াই যাঁদের একমাত্র কাজ ৷ অনু্রূপভাবে আকাশমূহ পরিপূর্ণ রয়েছে ফেরেশতাকুলের দ্বারা ৷
প্রতিদিন তাঁদের মধ্য থেকে সত্তর হাজার চতুর্থ আসমানে অবস্থিত বায়তুল মামূরে হাযির হন।দ্বিতীয়বার আর সেখানে তাঁদের আগমন ঘটে না ৷ তাসবীহ, তাহমীদ, তাকবীর এবং সালাত ও তাসলীমই তাঁদের একমাত্র ব্রত ৷
সৃষ্ট জীবের জন্য পানির তরঙ্গের উপর সৃজন করেছেন তিনি পৃথিবী, তার উপরে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা, আর আকাশ সৃষ্টিরও আগে চার দিনে তাতে ব্যবস্থা করেছেন তার জীবিকার এবং তাতে জােড়ায় জোড়ায়, সব কিছু সৃষ্টির বিষয়টি স্থির করেছেন ৷ শীতগ্রীষ্মে সর্বক্ষণ মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, বুদ্ধিমানদের জন্য পথ-নির্দেশ স্বরুপ এবং তাদের প্রয়োজনীয় ও মালিকানাধীন জীবজন্তু ৷ মাটি থেকে তিনি মানব সৃষ্টির সুচনা করেছেন এবং নিরাপদ আধারে তৃচ্ছ পানির নির্যাস থেকে তার বংশধর সৃষ্টি করে উল্লেখযোগ্য কিছু না থাকারপর ত কে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন, আর শিক্ষা দান করে তাকে করেছেন সম্মানিত ৷ আদিপিতা আদম (আ)-কে নিজের পবিত্র হাতে সৃষ্টি করেছেন তিনি, গঠন করেছেন তার অবয়ব ৷নিজের পক্ষ থেকে তার মধ্যে সঞ্চার করেছেন আত্মা এবং ফেরেশতাদেরকে তার সামনে করিয়েছেন সিজদাবনত ৷ তারপর তার থেকে তার সহধর্মিনী আদি মাতা হাওয়া (আ)-কে সৃষ্টি করে দুর করে দিয়েছেন তার নিঃসঙ্গতা এবং তাদেরকে বাস করতে দিয়েছেন তার জান্নাতে এবং পুর্ণ মাত্রায় দান করেছেন অফুরস্ত নিয়ামত ৷
তারপর তার মহাপ্রজ্ঞাময় পুর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদেরকে নামিয়ে দেন পৃথিবীর মাটিতে এবং তাদের থেকে বিস্তার ঘটিয়েছেন অসং খ্য নর-নারীর ৷ তাদেরকে বিভক্ত করেছেন রাজা-প্রজা, গরীব ধনী, স্বাধীন ও অধীন নর-নারীতে এবং তাদেরকে বসবাস করতে দিয়েছেন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ৷ বংশ পরম্পরায় বিচার দিনে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তাদের অধীন করে দিয়েছেন ছোট-বড় নদ-নদী উৎসারিত করে দিয়েছেন প্রয়োজন অনুসারে কুপ ও ঝর্ণারাজি এবং বারি বর্ষণ করে উৎপন্ন করেছেন রকমারী শস্য ও ফলমুল ৷ সর্বোপরি তাদেরকে দান করেছেন তিনি তাদের প্রয়োজন ও যাচঞা অনুসারে সবকিছু ৷ তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা করলে তার সং থ্যা নিন্য় করতে পারবে না ৷ মানুষ অবশ্যই অতিমাত্রায় জালিম, অকৃতজ্ঞ ৷ (১৪ : ৩৪) অতএব পবিত্রতা ঘোষণা করছি যে সত্তার, যিনি মহানুভব, মহান ও পরম সহনশীল ৷
মানব সৃষ্টি, তাদের জীবিকা প্রদান, তাদের পথ সুগম করে দেয়৷ এবং তাদেরকে বাকশক্তি দান করার পর ৰু তাদের প্ৰতি মহান আল্লাহর বিশেষ একটি নিয়ামত ও অনুগ্রহ হলো এই যে, তিনি তাদের নিকট প্রেরণ করেছেন তার নবী-রাসুলগণকে এবং নাযিল করেছেন তার হালাল-হারাম, যাবতীয় সমাচার ও বিধি-বিধান এবং সৃষ্টির সুচনা ও পুনরুথান সহ কিয়ামত পর্যন্ত সৎঘটিতব্য সব কিছুর বিশদ বিবরণ সম্বলিত কিতাবসমুহ ৷
সুতরাং ভাগ্যবান যে ব্যক্তি, যে সমাচড়ারসমুহকে সত্য বলে মেনে নেয় সাথে সাথে আদেশসমুহকে বশ্যত৷ ও নিষেধসমুহকে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নিয়ে স্থায়ী নিয়াম৩ রাজি লাভে ধন্য হলো এবং যাক্কুম, ফুটন্ত পানি ও যস্ত্রণাদায়ক শাস্তি বিশিষ্ট জাহান্নামে মিথ্যাবাদীদের অবস্থান থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকল ৷
আমি মহান আল্লাহর বিপুল উত্তম ও বরকতময় প্রশংসা বর্ণনা করছি-যা ভরে দেবে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীসমুহের প্রান্তরমালা কিয়ামত পর্যন্ত, অনম্ভকাল ধরে ৷ তার মাহাত্ম্য,
ক্ষমতা ও মহান সভার জন্য যেমন গােভনীয় ৷ আর সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ব্যতীত কোন
ইলাহ নেই, যার নেই কোন অংশীদার ৷ নেই কোন সন্তান, জনক, অর্থ বা সঙ্গিনী ৷ নেই তার
কোন সমকক্ষ এবং সেই কোন মস্ত্রণাদাতা বা উপদেষ্টা ৷
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা) তার বান্দা ও রাসুল, তার হাবীব ও খলীল ৷
আরবের বিশিষ্ট লোকদের যিনি সেরা, নির্বাচিত সর্বশেষ নবী, তৃষ্ণা নিবারণকারী সর্ববৃহৎ
হাউজের যিনি অধিপতি, কিয়ামতের দিন শ্রেষ্ঠ শাফাআতের যিনি একচ্ছত্র মালিক ও পতাকা
রহনকারী, যাকে আল্লাহ তাআলা অধিষ্ঠিত করবেন এমন এক প্রশংসিত স্থানে, যার আকাক্ষো
করবে সৃষ্টিকুল, এমনকি আল্লাহর খলীল ইবরাহীমসহ সকল নবী-রাসুল পর্যন্ত ৷ তার প্ৰতি ও
অন্য সকল নবী-রাসুলের প্রতি সালাত ও সালাম ৷
আর আল্লাহ সত্তুষ্ট হোন তার সাহাবাগণের প্ৰতি যারা মহা সম্মানিত, নেতৃস্থানীয় ও নবীদের
পরে জগতের সেরা ব্যক্তিত্ব ৷ যতক্ষণ আলো আর আধারের অস্তিত্ব থাকবে, আহবানকারীর
আহবান ধ্বনি উচ্চারিত হবে এবং দিন-রাতের আবর্তন অব্যাহত থাকবে ৷
হামৃদ ও সালাতের পর-এ কিভাবে আমরা আল্লাহর সাহায্য ও তার প্রদত্ত তাওফীক বলে
সৃষ্টি জগতের সুচনা তথা আরশ-কুরসী, আসমান-যমীন ও এসবের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সেই
ফেরেশতা, জিন ও শয়তান যা কিছু আছে তার সৃষ্টি, আদম (আ)-এর সৃষ্টির ধরন, বনী
ইসরাঈল ও জাহেলী যুগ পর্যন্ত নবীগণের কাহিনী এবং আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা)-এর সীরাত
যথাযথভাবে আলোচনা করব ৷
তারপর আলোচনা করব আমাদের যুগ পর্যন্ত সংঘটিত কাহিনী, যুগে যুগে সংঘটিতব্য
বিপর্যয়, ও সংঘাতসমুহ, কিয়ামতের আলামতসমুহ এবং পুনরুথান ও কিয়ামতের
বিডীষিকাসমুহ ৷ তারপর কিয়ামতের বিবরণ এবং সে দিনকার ভয়াবহ ঘটনাবলী ৷ তারপর
জাহান্নামের বিবরণ ৷ তারপর জান্নাতসমুহ ও জান্নড়াতের সুশীলা সুন্দরী রমণীগণের বিবরণ এবং
এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ৷
আমাদের এসব আলোচনার উৎস হবে কুরআন, সুন্নাহ ও নবুওতে মুহাম্মদীর দীপাধার
থেকে সংগৃহীত উলামা ও ওরাছাতৃল আম্বিয়ার বর্ণিত আছার ও আখবার তথা ইতিহাস ও
বিবরণ ৷ ইসরাঈলী ৰিবরণসমুহ থেকে আমরা কোন তথ্য উল্লেখ করব না ৷ তবে শরীয়ত
প্রবতকি মহানবী (সা), আল্লাহর কিতাব ও তার রাসুলের সুন্নাহর পরিপন্থী নয় এমন যা কিছু
উদ্ধৃত করতে অনুমতি দিয়েছেন তার কথা স্বতন্ত্র ৷ আর তড়াহলো সে সব ইসরাঈলী বিবরণ,
শরীয়ত যার সত্যাসত্য সম্পর্কে নিরব ৷ যাতে রয়েছে সংক্ষিপ্ত তথ্যের বিশদ ব্যাখ্যা কিৎবা
শরীয়তে বর্ণিত অস্পষ্ট তথ্যকে নির্দিষ্টকরণ, যাতে আমাদের বিশেষ কোন ফায়দা নেই ৷ কেবল
শোভাবর্ধনের উদ্দেশ্যে আমরা তা উল্লেখ করব-প্রয়োজনের তাগিদে, যা তার উপর নির্ভর
করার উদ্দেশ্যে নয় ৷ নির্ভর তো করব শুধু আল্লাহর কিতাব ও তার রাসুল (সা)এর সহীহ
কিংবা হাসান সনদে বর্ণিত সুন্নাহ্র উপর ৷ আর কোন বংনাির দৃর্বলতা থাকলে তাও আমরা
উল্লেখ করব ৷ আল্লাহরই নিকট আমাদের সাহায্য প্রার্থনা এবং তারই উপর আমাদের ভরসা ৷
ক্ষমতা তো একমাত্র মহান আল্লাহর হাতে ৷
আল্লাহ তাআলা তার পবিত্র গ্রন্থে বলেন :
অর্থাৎ-পুর্বে যা ঘটেছে তার সংবাদ এভাবে আমি তোমার নিকট বিবৃত করি এবং আমি
আমার নিকট থেকে তোমাকে দান করেছি উপদেশ ৷ (২০ : ৯৯)
আল্লাহ তাআলা তার নবী (সা) এর নিকট সৃষ্টির সুচনা, পুর্ববর্তী জাতিসমুহের প্রসঙ্গ,
অনুগতদের প্রতি তার আনুকুল্য এবং অবাধ্যদের প্রতি শাস্তি ইত্যাদির বিবরণ দিয়েছেন ৷
আবার রাসুলুল্লাহ (সা) তার উম্মঙে র উদ্দেশে তার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন ৷ প্রতিটি পরিচ্ছেদে
ত্শ্লিষ্ট বিষয়ে বর্ণিত আয়াত তসমুহের পাশাপাশি আমরা রাসুলুল্লাহ (সা) থেকে আমাদের পর্বত
পৌছেছে এমন বর্ণনাসমুহ উপস্থাপন করব ৷ উল্লেখ্য যে, মহানবী (সা) আমাদের প্রয়োজনীয়
বিষয়ড়াবলী জানিয়ে দিয়েছেন আর যাতে আমাদের কোন উপকার নেই তা বর্জন করেছেন ৷ তবে
ইহুদী-খৃক্টান পণ্ডিতদের বেশ কিছু লোক তা জানা ও বুঝার জানা গলদঘর্ম হয়েছেন, যাতে
আমাদের অধিকাংশ লোকেরই কোন ফায়দা নেই ৷ আমাদের একদল আলিমও সেগুলো
অড়াদ্যেড়াপান্ত উদ্ধৃত করেছেন ৷ আমরা তাদের পথ অনুসরণ করবো না ৷ তবে আমরা
, সংক্ষিপ্তভাবে তা কিঞ্চিত উল্লেখ করব এবং আমাদের নিকট যা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে,
তার সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ বিষয়াদি এবং যা তার বিপরীত বলে সমালোচিত হয়েছে তা আমরা
বর্ণনা করবো ৷ তবে ইমাম বুখারী(র) তার সহীহ বুখারীতে আমর ইবন আস (রা) সুত্রে এ
মর্মে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন :
অর্থাৎ “আমার পক্ষ থেকে একটি বাক্য হলেও তোমরা তা আমার পক্ষ থেকে পৌছিয়ে
দাও, বনী ইসরাঈল সুত্র থেকেও বর্ণনা করতে পার তাতে কোন অসুবিধা নেই এবং আমার পক্ষ
থেকে বর্ণনা কর, তবে আমার নামে মিথ্যা রটনা করো না ৷ ইচ্ছাকৃতভাবে যে ব্যক্তি আমার
নামে মিথ্যা রটনা করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয় ৷” তা আমাদের মতে ঐ
সব ন্ইসরাঈলী রেওয়ায়েত সম্পর্কে প্রযোজ্য, যার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বক্তব্য নেই ৷ সুতরাং
সেগুলোকে সত্য বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মত কিছু আমাদের কাছে নেই ৷ তইি শিক্ষণীয় বিষয়
হিসাবে এসব রেওয়ায়ত বর্ণনা করা জায়েয আছে ৷ এ জাতীয় বর্ণনাই আমরা আমাদের এ
কিভাবে ব্যবহার করব ৷
পক্ষান্তরে আমাদের শরীয়ত যার সভ্যতার সাক্ষ্য দিয়েছে; আমাদের তা বর্ণনা করার
প্রয়োজন (নই-আমাদের কাছে যা আছে তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট ৷ আর আমাদের শরীয়ত
যাকে বাতিল বলে সাক্ষ্য দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যাত এবং প্রত্যাখ্যান বাতিল ঘোষণা করার উদ্দেশ্যে
বর্ণনা করা না জায়েয ৷ যা হোক, মহান আল্লাহ যখন আমাদের ও রাসুল (সা) দ্বারা অন্য সব
শরীয়ত থেকে এবং তার কিতাব দ্বারা অন্য সব কিতাব থেকে আমাদেরকে অমুখাপেক্ষী
করেছেন; তখন আমরা বনী ইসরাঈলদের সে সব বর্ণনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না,
যেগুলােতে রয়েছে প্রক্ষেপ ও মিশ্রণ, মিথ্যা ও বানােয়াট, বিকৃতি ও পরিবর্তন এবং সর্বোপরি
সেগুলো রহিত হয়ে গেছে ৷ মােটকথা, যা প্রয়োজনীয়, রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের জন্য তা স্পষ্ট
ও বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন ৷ কেউ তা অনুধাবন করতে পেরেছে, কেউ বা পারেনি ৷
যেমন আলী ইবন আবুতালিব (রা) বলেন :
অর্থাৎ-আল্লাহর কিভাবে তোমাদের পুর্বকালীন সমাচার, পরবর্তীকালের ঘটনাবলী এবং
তোমাদের বর্তমানের বিধি-বিধান রয়েছে ৷ এটাই চুড়ান্ত ফয়সালা এটা কোন হেলা-ফেলার
ব্যাপার নয় ৷ যে মদমত্ত ব্যক্তি তা বর্জন করবে, আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করবেন আর যে কেউ তা
ছেড়ে অন্য কোথাও হিদায়ত অনুসন্ধান করবে আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করবেন ৷
আবু বর (বা ) বলেন :
অর্থাৎ-রাসুলুল্লাহ (সা) তার ওফাতের পুর্বেই দু’ডড়ানায় ভর করে উড়ে যাওয়া পাখি
থেকেও আমাদেরকে শিক্ষা দান করেছেন ৷
ইমান বুখরীি (র) সৃষ্টির সুচনা অধ্যায়ে বলেন : তারিক ইবন মুসা (র) সুত্রে বর্ণিত আছে
যে, তিনি বলেন : আমি উমর ইব ন খাত্তাব (রা)-কে বলতে শুনেছি যে, “রাসুলুল্লড়াহ (সা)
একন্থানে আমাদের মাঝে দাড়িয়ে সৃষ্টির সুচনা থেকে জান্নড়াভীদের তাদের মনযিলে এবং
জাহান্নড়ামীদের তাদের মনৃযিলে প্রবেশ করা পর্যন্ত অবস্থার সংবাদ প্রদান করেন ৷ কেউ তা
মুখঃস্থু রাখতে পেয়েছে, কেউ বা তা তুলে গিয়েছে ৷
ইমাম আহমদ ইবন হড়াম্বল (র) তার মুসনাদে আবু যায়দ অড়ানসারী (ব) সুত্রে বর্ণনা করেন
যে, রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করে মিম্বরে আরোহণ করেন
এবং জোহর পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশে খুতবা দান করেন ৷ তারপর মিন্বর থেকে নেমে জোহরের
নামায আদায় করে আবার মিশ্বরে আরোহণ করেন এবং আসরের ওয়াক্ত পর্যন্ত আমাদেরকে
খুতবা দান করেন ৷ তারপর মিম্বর থেকে নেমে আসর নামায আদায় করেন ৷ তারপর আবার
মিম্বরে আরোহণ করে সুর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত খুতবা দান করেন ৷ তাতে তিনি অতীতে যা
ঘটেছিল এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবে তার বিশদ বিবরণ দেন ৷ আমাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী তা
বেশি স্মরণ রাখতে পেয়েছেন ৷ ’ কেবল ইমাম মুসলিম তার সহীহ’-এর কিতাবুল ফিতানে’ এ
হাদীসখানা বর্ণনা করেছেন ৷
আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (১ম খণ্ড) ৭-
আল্লাহ তড়াআলা তার মহান গ্রন্থে বলেনং :
অর্থাৎ “আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর কম বিধায়ক ৷ (৩৯ং : ৬২)
মােটকথা, আল্লাহ তড়াআলা ব্যতীত যা কিছু আছে সবই তার সৃষ্ট, পােষ্য, নিয়ন্ত্রণাধীন,
নাস্তি থেকে অস্তিত্ব প্রাপ্ত ৷ অতএব, গোটা সৃষ্টি জগতের ছাদস্বরুপ আরশ থেকে আরম্ভ করে
পাতাল পর্যন্ত এবং এ দৃ’টির মধ্যকার জড় ও জীব নির্বিশেষে সবই তার সৃষ্ট, তার কর্তৃত্বড়াঘীন
তার আজ্ঞাবহ এবং তার নিয়ন্ত্রণ, কুদরত ও ইচ্ছার অধীন ৷ আল্লাহ তাআলা বলেন
অর্থাৎ “তিনিই ছদিনে (ছয়টি সময়কালে) আকাশরাজি ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন
তারপর আরশে সমাসীন হয়েছেন ৷ যা কিছু ভুমিতে প্রবেশ করে ও যা কিছু তা থেকে বের হয়
এবং আকাশ থেকে যা কিছু সালে ও আকাশে যা উথিত হয় সে সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ৷ তোমরা
যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন; তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তা
দেখেন ৷ (৫৭ ৪৪)
শাস্ত্রবিদগণ এ ব্যাপারে এমন অভিন্ন অভিমত পোষণ করেন, যাতে কোন মুসলিমের তাতে
সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আল্লাহ তাআলা আকাশসমুহ, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যবর্তী সব
কিছু ছদিনে সৃষ্টি করেছেন, যেমন কুরআনে করীমে বর্ণিত হয়েছে ৷ তবে এদিন কি আমাদের
পৃথিবীর দিনের ন্যায়, নাকি তার প্রতিটি দিন হাজার বছরের সমান? এ ব্যাপারে দু’টি অভিমত
রয়েছে ৷ আমি আমার তাফসীর গ্রন্থে এ বিষয়টি আলোচনা করেছি এবং এ কিতাবেও যথান্থানে
তার আলোচনা করব ৷ অড়াকাশসমুহ ও পৃথিবী সৃষ্টির পুর্বে কোন সৃষ্টির অস্তিত্ব ছিল কি না-এ
ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে ৷ কালাম শাস্ত্রবিদপণের একদলের মতে আকাশসমুহ ও পৃথিবীর
পুর্বে কিছু ছিল না ৷ নিতান্ত নাস্তি থেকেই এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে ৷ অন্যরা বলেন বরং
আকাশমওলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পুর্বে অন্য মাখলুকের অস্তিত্ব ছিল ৷ তার প্রমাণ আল্লাহ তাআলার
বাণী০ :
অর্থাৎ তিনিই আকা ৷শমণ্ডলী ও পৃথিবী ছ দািন (ছয়টি সময়কালে) সৃষ্টি করেন, তখন তার
আরশ ছিল পানির উপর ৷ ( ১ ১ ৭)
ইমরান ইবন হুসায়ন (রা) বর্ণিত হাদীসে আছে :
অর্থাৎ “আল্লাহ ছিলেন, তার আগে কিছুই ছিল না, তখন তার আরশ ছিল পানির উপর ৷
আর স্মারকলিপিতে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে পরে তিনি আকা ৷শমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন ৷
ইমাম আহমদ (র) আবু রাযীন লাকীত ইবন আমির আকীলী (র) সুত্রে বর্ণনা করেন যে,
তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্পাহা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আগে আমাদের
প্ৰতিপালক কে ৷থায় ছিলেন ? রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন : মেঘমালার দেশে যার উপরেও শুন্য,
নিচেও শুন্য, তারপর পানির উপর তিনি তার আরশ সৃষ্টি করেন ৷
ইমাম আহমদ (র) য়াষীদ ইবন হারুন ও হা স্ফোদ ইবন সালামা (র) সুত্রেও হাদীছটি বর্ণনা
করেছেন ৷ তবে তার প্রথমাংশের শব্দ হলো মাখৃলুক সৃষ্টি করার আগে আমাদের প্রতিপালক
কোথায় ছিলেন? অবশিষ্টাৎশ একই রকম ৷
ইমাম তিবমিযী ও ইবন মাজাহ্ (র) ভিন্ন সুত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ৷ ইমাম তিবমিযী
(র) হাদীসটি হাসান বলে মন্তব্য করেছেন ৷
আবার এসবের মধ্যে কোনটা সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে এ ব্যাপারেও আলিমগণের
মতভেদ রয়েছে ৷ একদল বলেন, সব কিছুর আগে কলম সৃষ্টি করা হয়েছে ৷ এটা ইবন জারীর
ও ইবন জাওযী (র) প্রমুখের অভিমত ৷ ইবন জারীর বলেন : আর কলমের পর সৃষ্টি করা
হয়েছে হালকা মেঘ ৷ তাদের দলিল হলো, যে হাদীস যা ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও
তিবমিযী (র) উবাদা ইবন সামিত (রা) সুত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন :
ان اول ما خلق الله القلم ثم قال له اكتب فجري في تلك الساعة كائن الي يوم القيامة
অর্থাৎ “আল্লাহ সর্বপ্রথম বা সৃষ্টি করেছেন তাহলো, কলম ৷ তারপর তাকে বললেন,
লিখ-তৎক্ষণাৎ সে কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে, তা লিখে চলল ৷ হাদীসে এ পাঠটি ইমাম
আহমদের ৷ ইমাম তিবমিযী (র) হাদীসটি হাসান সহীহ শরীর বলে মন্তব্য করেছেন ৷
পক্ষান্তরে হাফিজ আবুল আলা হামদানী (র) প্রমুখ এর বর্ণিত তথ্য মোতাবেক জমহুর
আলেমগণের অভিমত হলো সর্বপ্রথম মাখলুক হলো, আরশ’ ৷ ইবন জারীর যাহ্হাক সুত্রে
ইবন আব্বাস (রা) থেকে এটিই বর্ণনা করেছেন ৷ সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ইমাম মুসলিমের
হাদীসটিও এর প্রমাণ বহন করে ৷ তাহলো : ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবন
আমর ইবন আস (রা) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি !
অর্খাৎ আকা শমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চা ৷শ হাজার বছর আগেই আল্লাহ সৃষ্টি জগতের
তাকদীর লিপিবদ্ধ করে রাখেন ৷ তখন তার আরশ ছিল পানির উপর ৷
আলিমগণ বলেন : আল্লাহ্ তড়াআলার কলম দ্বারা মাকাদীর লিপিবদ্ধ করাই হলো, এ
তাকদীর ৷
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, এ কাজটি আরশ সৃষ্টির পরে হয়েছে ৷ এতে আল্লাহ যে কলম
দ্বারা মাকাদীর লিপিবদ্ধ করেছেন, আরশ তার আগে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে প্রমাণিত হয় যা
জমহ্রর-এর অভিমত ৷ আর যে হাদীসে সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে তার অর্থ
হলো, কলম এ জগতের সৃষ্টিসমুহের প্রথম ৷ ইমরান ইবন হুসায়ন (র) থেকে ইমাম বুখরীর (র)
বর্ণিত হাদীসটি এ মতে র পরিপুরক ৷ ইমরান ইবন হুসায়ন (রা) বলেনঃ ইয়ামানের কতিপয়
লোক রাসুলুল্লাহ (না)-কে বলল, দীন সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং এ সৃষ্টি জগতের সুচনা সম্পর্কে
আপনাকে জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে আমরা আপনার কাছে এসেছি ৷ জবাবে তিনি বললেন :
অর্থাৎ আল্লাহ ছিলেন, তার আগে কিছুই ছিল না এবং তার আরশ ছিল পানির উপর ৷
স্মরকলিপিতে তিনি সবকিছু লিপিবদ্ধ করে পরে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন ৷
এক বর্ণনায় এ দ্ব (তার আগে) এর স্থলে (তার সাথে) এসেছে ৷ আর অন্য বর্ণনায় এর স্থলে
মোটকথা, তারা নবী করীম (সা) কে আকাশমওলী ও পৃথিবী সৃষ্টির সুচনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করেছিল ৷ আর এ জন্য৩ তারা বলেছিল, আপনাকে এ সৃষ্টি জগতে র প্রথমটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস
করতে আমরা আপনার নিকট এসেছি ৷ ফলে রাসুলুল্লাহ (না) ঠিক ততটুকুই জবাব দেন যতটুকু
তারা জানতে ঢেয়েছিল ৷ এ কারণেই তিনি তাদেরকে আরশ সৃষ্টির সং বাদ দেননি, যেমন
পুর্ববর্তী আবু রাযীনের হাদীসে দিয়েছেন ৷ ইবন জারীর (র) বলেন, আর অন্যদের মতে আল্লাহ
তাআলা আরশের আগে পানি সৃষ্টি করেছেন ৷
সুদ্দী আবু মালিক ও আবু সালিহ (র) সুত্রে ইবন আব্বাস (রা) থেকে, মৃররা সুত্রে ইবন
মাসউদ (বা) থেকে এবং আরো কতিপয় সাহারা থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা বলেন :
আল্লাহর আরশ পানির উপর ছিল আর পানির আগে তিনি কিছুই সৃষ্টি করেননি ৷
ইবন জারীর মুহাম্মদ ইবন ইসৃহাক (র) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন : আল্লাহ
তড়াআলা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন, তাহলো-আলো ও অন্ধকার ৷ তারপর দৃ’য়ের মাঝে পার্থক্য
সৃষ্টি করে তিনি অন্ধকারকে কালো আধার রাতে এবং আলোকে উজ্জ্বল দিবসে পরিণত করেন ৷
ইবন জারীর (র) আরো বলেন যে, কেউ কেউ বলেছেন, আমাদের প্রতিপালক কলমের পর
যা সৃষ্টি করেছেন তাহলো কুরসী ৷ তারপর কুরসীর পরে তিনি আরশ সৃষ্টি করেন ৷ তারপর
মহাশুন্য ও আবার এবং তারপর পানি সৃষ্টি করে তার উপর নিজের আরশ স্থাপন করেন ৷ বাকি
আল্লাহ্ তাআলা ভালো জানেন ৷
আর্শ ও কুরসী সৃষ্টির বিবরণ
আল্লাহ তা’আলা
অর্থাৎ তিনি সমুচ্চ মর্যাদার অধিকারী আরশের অধিপতি’ ৷ (৪ঃ১৫)
অর্থাৎ মহিমান্বিত আল্লাহ, যিনি প্রকৃত মালিক তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই ৷ সম্মানিত
আরশের তিনি অধিপতি ৷ (২৩০ঃ ১১৬)
অর্থাৎ তুমি জিজ্ঞেস কর, কে সাত আকাশ এবং মহা আরশের অধিপতি ? (২৩ঃ ৮৬)
অর্থাৎ তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়, আরশের অধিকারী ও সমানিত’ ৷ (৮৫ঃ ১৪ -১৫)
অর্থাৎ দয়াময়, আরশে সমাসীন ৷ ’ (২০ : ৫)
অর্থাৎ তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন ৷ (১০ : ২)
এসব সুরা সহ কুরআনের আরো বহুস্থানে এ আয়াতটি রয়েছে ৷
অর্থাৎ “ যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা তার চারপাশ ঘিরে আছে, তারা তাদের
প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে
এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান
সর্বব্যাপী ৷ (৪০ : ৭)
অর্থাৎ সে দিন আটজন ফেরেশতা তাদের প্রতিপালকের আরশকে তাদের উর্ধ্বে ধারণ করবে ৷ (৬৯ং : ১৭)