আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) এর সাথী
ফেরেশতাদের মাঝে যিনি রাসূল (সঃ) এর সবচেয়ে নিকটবর্তী ছিলেন, যিনি রাসূল (সঃ) কে সহযোগিতা করেছেন, তাঁর প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন তিনি ছিলেন জিব্রিল আঃ। অন্য একটি বর্ণনায় রাসূল (সঃ) আরও বলেছেন, …… প্রত্যেক নবীকেই আল্লাহ সুব হানাহু ওয়া তায়ালা দুনিয়া থেকে দুইজন এবং আকাশ থেকে দুইজন মন্ত্রী দান করেছেন। আমাকে দেয়া আকাশের দুইজন মন্ত্রী হলেন – জিব্রিল এবং মিকাল। আর দুনিয়া থেকে প্রদত্ত দুইজন হলেন- আবু বকর এবং ওমর (রা)। জিব্রিল আ এবং রাসূল সঃ এর প্রথম সাক্ষাৎকারটি কেমন ছিল? আনাস ইবনে মালিক (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সঃ) এর ছেলেবেলায় তিনি অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলছিলেন, দৌড়াদৌড়ি করছিলেন – ঠিক সকল বাচ্চার মত। হঠাৎ করে এক ব্যক্তির আবির্ভাব হলো। তিনি রাসূল (সঃ) কে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিলেন। এটা দেখে অন্য বাচ্চারা তাদের পিতা-মাতার কাছে দৌড়ে চলে গেল আর বলতে লাগলো – মুহাম্মাদ (সঃ) কে হত্যা করা হয়েছে। অন্য বাচ্চারা যখন দৌড়ে পালাতে লাগলো, তখন রাসূল (সঃ) দেখছিলেন যে এই লোকটি তাঁকে কি করতে যাচ্ছে। আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেন, তিনি আমার বুক কেটে ফেললেন, তিনি আমার বুক খুলে ফেললেন। তিনি রাসূল (সঃ) এর হার্ট ধরলেন এবং তা থেকে কিছু একটা বের করে নিলেন আর বললেন- এটা হলো তোমার অন্তরের শয়তানের অংশ। তারপর তিনি এটাকে ফেলে দিলেন। তারপর তিনি সোনালি বর্ণের একটি পাত্রে রাখা জমজমের পানিতে আমার হার্ট ধুয়ে ফেললেন। আর এই বাচ্চাবস্থায় রাসূল (সঃ) সবকিছু অবলোকন করছেন। এরপর রাসূল (সঃ) এর হার্টকে আবার যথাস্থানে রেখে দেয়া হলো। অন্য বাচ্চারা ফিরে এসে দেখল যে রাসূল (সঃ) এর বুক সেলাই করে দেয়া হয়েছে। আর তাঁর মুখমণ্ডল নীল বর্ণ ধারণ করলো। রাসূল (সঃ) এর হার্ট বের করে পবিত্র করা হলো। সে সময় তিনি এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন না। তিনি এই ঘটনায় চরম কষ্ট পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন না যে এটা কি হল!!
ঠিক ৩৪ বছর পর, তিনি যখন ৪০ বছর বয়সে পদার্পণ করেন- আয়েশা রা বলেন, তিনি (সঃ) সত্য ভাল স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। এটা তিনি একাধারে ৬ মাস যাবত দেখতে লাগলেন। তিনি রাতে যা স্বপ্নে দেখতেন তাই দিনের বেলায় সত্যে পরিণত হতো। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এ থেকে আমরা কিছুটা বুঝতে পারি যে, কেন হঠাৎ করে রাসূল (সঃ) গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন হতে লাগলেন এবং প্রার্থনা করতে লাগলেন। তিনি এবং খাদিজা (রা) বুঝতে পারলেন যে, অতি প্রাকৃতিক কিছু ঘটছে। ঐশ্বরিক কেউ একজন তাদের সাথে যোগাযোগ করছে। কোন এক ধরণের বিশেষ সৃষ্টি তাদের সাথে যোগাযোগ করছে। এ অবস্থা ৬ মাস যাবত চলল।
আয়েশা (রা) বলেন, তারপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নির্জনতাকে রাসূল (সঃ) এর নিকট প্রিয় করে দিলেন। হঠাৎ করেই তিনি একা থাকতে পছন্দ করা শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেরা গুহায় আরোহণ করতেন। হেরা গুহায় আরোহণ করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আপনারা যদি কখনো হেরা গুহায় উঠেন তাহলে সম্পূর্ণ মক্কাকে দৃষ্টি সীমায় দেখতে পাবেন। সুবহান আল্লাহ! আপনি সবকিছু দেখতে পাবেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) দিনের পর দিন, কখনো পুরো সপ্তাহ জুড়ে, অবশেষে পুরো রমজান মাস সেখানে অবস্থান করেন। তিনি সেখানে দ্বীনে হানিফ তথা ইব্রাহীম আঃ এর শেখানো পন্থায় এক আল্লাহর ইবাদাত করতেন। অর্থাৎ তিনি সেখানে গিয়ে যেভাবে পারতেন আল্লাহর ইবাদাত করতেন, সুশৃঙ্খল কোন নামাজের নিয়ম তখন জানা ছিল না। তিনি ইব্রাহীম আঃ এর রেখে যাওয়া নিয়মে আল্লাহকে ডাকতেন, ঠিক এটাই বর্ণিত আছে। তো, হঠাৎ করে একদিন তিনি জিব্রিল আঃ কে দেখতে পান। আপনাদের কি মনে হয়, তখন জিব্রিল আঃ কি ফেরেশতার আকৃতিতে দেখা দেন, না মানুষের আকৃতিতে? মানুষের আকৃতিতে।
আপনারা হয়তো ভাবছেন, রাসূল (সঃ) তাহলে ভয় পেলেন কেন? চিন্তা করে দেখুন, আপনি হয়তো দুই ঘণ্টা ধরে সেখানে অবস্থান করছেন, আশে পাশে কেউ নেই। তারপর আচমকা গুহার মুখে এক অপরিচিত লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন, আর সে লোকটি আপনার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলো, কোন কথা বলছে না। আপনি যদি রাসূল (সঃ) এর জায়গায় থাকতেন, আপনি কি ভাবতেন? তাছাড়া পরবর্তী কালের বর্ণনা থেকে আমরা ধারণা পাই তখন কি ঘটেছিল রাসূল (সঃ) এর প্রতি? রাসূল (সঃ) যখন খাদিজা (রা) এর নিকট ঘটনা বর্ণনা করছিলেন, তিনি বলেন- ”যাকে আমি স্বপ্নে দেখি সে আমার নিকট এসেছিল।” সুতরাং আমরা আরও বুঝলাম যে, রাসূল (সঃ) ইতিমধ্যে জিব্রিল (আঃ) কে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তো, তিনি চিন্তা করছিলেন – আজব তো, আমি তো এখন ঘুমাচ্ছি না। আমি তো স্বপ্নে নই, বাস্তবে!! এর থেকে জিবরাইল (আঃ) কেন রাসূল (সঃ) কে জড়িয়ে ধরেছিলেন তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব। ‘ইকরা’ পড়ুন। পড়ুন, আপনি কল্পিত কিছু দেখছেন না। এটা কল্পিত কোন ছায়ামূর্তি নয়। আমি বাস্তবেই আপনার সামনে। আমি আপনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরছি শুধু আমার বাস্তবতা বুঝাতে নয়, إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلًا ثَقِيلًا যে ওহী আপনার উপর নাযিল হতে যাচ্ছে তা হবে অত্যন্ত ভারী।
এ বাণী ধারণ করার জন্য আপনাকে প্রস্তুত হতে হবে। অতঃপর তিনি তাঁকে আদেশ করলেন, পড়ুন। তারপর রাসূল সঃ কে ছেড়ে দিলেন। রাসূল (সঃ) বললেন – আমি পড়তে জানি না। জিব্রিল (আঃ) তাঁকে আবার আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন- পড়ুন। রাসূল (সঃ) বললেন – আমি পড়তে জানি না। জিব্রিল (আঃ) রাসূল (সঃ) কে তৃতীয়বারের মত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। (পরবর্তী কালে রাসূল সঃ বর্ণনা করেন) জিব্রিল (আ) আমাকে এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন যে আমি মনে করছিলাম আমি মারা যাবো। তিনি বললেন- পড়ুন। রাসূল (সঃ) বললেন- কি পড়বো? ঠিক তখন জিব্রিল (আঃ) বললেন- اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ‘আলাকা’ থেকে। اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। রাসূল (সঃ) যখন ওহী গ্রহন করছিলেন- জিব্রিল (আঃ) তাঁকে আর জড়িয়ে ধরলেন না। আবার চলেও গেলেন না। রাসূল (সঃ) গুহা ত্যাগ করে তাড়াতাড়ি নেমে গেলেন।
খাদিজা (রা) বলেন- কি হয়েছে? এখন দেখুন, রাসূল (সঃ) যখন তাঁকে বললেন কি ঘটেছে খাদিজা (রা) সহজেই তাঁকে বলতে পারতেন- আপনি ঐ গুহায় যাওয়া বন্ধ করুন। আপনার মনে হয় বাসায় থাকা উচিত। ভুলে যান সবকিছু। আপনি ঘরের ঐ কোণায় ধ্যান করতে পারেন। কেউ আপনাকে ডিস্টার্ব করবে না। ইনশাআল্লাহ, এ রকম কিছু আর ঘটবে না। কিন্তু তিনি এসবের কিছুই বললেন না। দেখুন, কেমন চমৎকার ছিলেন তিনি। সুব হানাল্লাহ! রাসূল সঃ নিজে নিজের উপর বিশ্বাস করার আগে খাদিজা তাঁর উপর বিশ্বাস করেন। সত্যিই। তিনিই রাসূল সঃ কে বলেন …… আল্লাহ কখনই আপনাকে অপমানিত করবেন না। তিনি আমাদের রাসূল সঃ এর গত ১৫ বছরের জীবনী বর্ণনা করতে লাগলেন। আপনি এমন মানুষ যিনি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করেন। আপনি এতিমদের, গরীবদের যত্ন নেন। আপনি আপনার প্রতিবেশী এবং মেহমানদের প্রতি উদার। কেউ কোন সমস্যায় পড়লে আপনি তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। আল্লাহ কখনই আপনাকে অপমানিত করবেন না।