এখন প্রয়োজন চোখের পানি নয়, এখন প্রয়োজন জিহাদের আগুন। কলমের কালি নয়, এখন প্রয়োজন বুকের তাজা খুন এবং দুর্বলের ফরিয়াদ নয়, এখন প্রয়োজন বজ্রের গর্জন।
কিন্তু আমার মত কমযোর-বুযদিল চোখের পানি ও কলমের কালি ছাড়া আর কী ঝরাতে পারে!
আমার বুকে তো নেই ঈমানের কুওয়াত, আমার দিলে তো নেই মুজাহিদের হিম্মত, আমার শিরায় তো নেই রক্তের সেই উচ্ছ্বাস! আমি শুধু কাঁদতে পারি আর লিখতে পারি। তাই ভেবেছিলাম, আজ এই নিঃসঙ্গ রাতে শুধু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে অশ্রুর কালিতে আমি কিছু লিখবো।
আমি লিখবো আফগানিস্তানের নিঃসঙ্গ মুজাহিদের কথা,রক্তের সফরে যাদের সঙ্গী হলো না মুসলিম বিশ্বের কোন দেশ ও দেশ-নেতা। তবু তারা শরীরের জখম এবং হৃদয়ের ক্ষত নিয়ে অবিচল রয়েছে জিহাদের পথে। অস্ত্র নেই, আশ্রয় নেই, অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, দুনিয়ার কোন উপায়-উপকরণ নেই। তবুও তারা পড়ে আছে পাহাড়ে-পর্বতে, গুহায়-গহবরে শুধু আল্লাহর উপর ভরসা করে।
ভেবেছিলাম, আমি লিখবো ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের কথা, যাদের জান-মাল, ইজ্জত-আবরু এবং শহর ও জনপদ ধ্বংস হয়ে গেছে ইহুদী হায়েনাদের হাতে। পঞ্চাশ বছর ধরে যারা দেশছাড়া বাস্তুহারা, যাদের বাঁচার কোন উপায় নেই আত্মঘাতী হামলা ছাড়া, কিন্তু মানবতার মোড়লদের চোখে তারা হলো সন্ত্রাসী, আর ইহুদী হায়েনা হলো শান্তিবাদী।
ভেবেছিলাম, আমি লিখবো গুজরাটের অসহায় বনী আদমের কথা, মুসলিম পরিচয়ের অপরাধে হিন্দু নরপশুদের হাতে যারা আজ ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নিধনযজ্ঞের শিকার, অথচ মুসলিম বিশ্ব নির্বিকার! এটা নাকি ভারতের ভিতরের ব্যাপার! আর যারা মানবতার দাবিদার, কোথায় তাদের সভ্যতা? কোথায় তাদের মানবতা ও মানবাধিকার?
যেখানে জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়, নিষ্পাপ শিশুকে ত্রিশূলে গেঁথে হত্যা করা হয়, যেখানে আমার মা-বোনকে…
নাহ, আর পারছি না, আর সহ্য হয় না।
ভেবেছিলাম, আমি লিখবো আরকানের মুসলিমদের কথা, যারা ঐ নেড়া বোদ্ধৃদের হাতে জান, মাল, ইজ্জত-আবরু হারিয়েছে এবং যাদের শহর ও জনপদ সব শেষ হয়ে গেছে নেড়া বৌদ্ধদের হাতে। যুগ যুগ ধরে তারা দেশছাড়া বস্তুহারা, মানবাধিকার আজ অন্ধ, উলটো জঙ্গী তাকমা দিয়ে তারা এখন সন্ত্রাসী আর বৌদ্ধরা ধুয়া তুলসী পাতা।
ভেবেছিলাম আজ এই নিঃসঙ্গ রাতে শুধু নিজেকে সান্ত্বনা দিতে অশ্রুর কালিতে আমি লিখবো তাদের কথা যাদের সাথে আমার বন্ধন ঈমানের এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের, যাদের সাথে আমার সম্পর্ক একই দেহের বিভিন্ন অঙ্গের। কিন্তু আমার চোখে আজ কান্না এলো না, আমার কলমে স্পন্দন জাগলো না। তাহলে? তাহলে কি ঈমানের শেষ চিহ্নটুকুও মুছে গেলো আমার হৃদয় থেকে?
এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলার, এক ফোঁটা কালি ঝরাবার এবং একটু আর্তনাদ করার যোগ্যতাও কি হারিয়ে গেলো আমার?
হঠাৎ মনে হলো, আমার মাঝে এক নতুন সত্তা জেগে উঠলো এবং চাবুকের আঘাত আমাকে জাগিয়ে তুললো। এতদিন আমি চোখের পানিতে এবং কলমের কালিতে শান্তনা খুঁজেছিলাম,তাই নিজেকে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ নিজের মাঝে আমি যেন সত্যিকার আমাকে খুঁজে পেলাম।
দিল থেকে আমার কমযোরি ও বুযদিলি এবং ভীরুতা ও অক্ষমতার অনুভূতি মুছে গেলো। আমার সমগ্র সত্তায় ঈমানের বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হলো এবং শিরায়-উপশিরায় সেই রক্ত টগবগ করে উঠলো যা একদিন ঝরেছিলো বদরে, উহুদে ইয়ারমুকে কাদেসিয়ায় এবং যুগে যুগে ইতিহাসের লালপাতায়।
আমার আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি শপথ নিলাম, শুধু চোখের পানি নয়, শুধু কলমের কালি নয়, আল্লাহর রাস্তায় এবার ঝরবে আমার বুকের রক্তও। হে আল্লাহ! আমাকে আমি তোমার হাতে সঁপে দিলাম, যেভাবে তোমার পছন্দ আমার চোখের পানি, আমার কলমের কালি এবং আমার বুকের রক্ত তোমার দ্বীনের জন্য এবং তোমার পেয়ারা হাবীবের জন্য ব্যবহার করো।
আমি শুধু দেখতে চাই, দুনিয়াতে তোমার দ্বীন আবার যিন্দা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ তার হারানো গৌরব আবার ফিরে পেয়েছে। ইসলামের হিলালী ঝাণ্ডা আবার সগৌরবে উড্ডীন হয়েছে। তাহলে আমি ভুলে যাবো বসনিয়া ও চেচনিয়ার বিভীষিকা। ভুলে যাবো ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের ভয়াবহতা। ভুলে যাবো এমনকি গুজরাটে আমার মুসলমান ভাইদের নিধনযজ্ঞের ও আরাকানি ভাই বোনদের বীভৎসতা।
(মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ আদীব হুজুর হাফিযাহুল্লাহ)
(সূত্রঃ- আল-কলম/ ৩য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, রবিউল আউয়াল, ১৪২৩ হিঃ/ পুষ্প সমগ্র/ পৃঃ ৪১৪)