অদৃষ্ট বিশ্বাসের মর্মকথা
মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
তাকদীর বা ভাগ্যবিশ্বাস ইসলামের অন্যতম প্রধান আকীদা। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মু’মিন ও মুসলিমরূপে গণ্য হয় না। বিশ্বাসটির সারকথা হল- জগতে এ পর্যন্ত ভালোমন্দ যা কিছু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে সৃষ্টিকর্তা পূর্বেই নিজ জ্ঞান ও ইচ্ছা মোতাবেক তা স্থির করে রেখেছেন। তাঁর সে স্থিরীকরণকে কাযা (ফয়সালা) ও কদর (পরিমাপ, নির্ধারণ) বলে। কি কি জিনিস সৃষ্টি হবে, কত পরিমাণে হবে, কি আকৃতিতে হবে, কে কতকাল বাঁচবে, কে কিভাবে কি পরিমাণে জীবিকা লাভ করবে, কার কি রোগ-ব্যাধি হবে, কি উপায়ে আরোগ্যলাভ হবে, মোটকথা ব্যক্তি ও জাতির উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, নির্মাণ-ধ্বংস ও হাসি-কান্নার যাবতীয় ঘটনা পূর্বেই স্থিরীকৃত হয়ে আছে এবং লাওহে মাহফুজে তা লিখে রাখা হয়েছে। এটাই তাকদীর এবং সে অনুসারেই সবকিছু ঘটছে।
মানুষ ছাড়া অন্যসব সৃষ্টির নিজস্ব কোন বুদ্ধি-বিবেচনা ও ইচ্ছাশক্তি নেই। তারা প্রাকৃতিকভাবেই সেই অনাদি ফয়সালা অনুযায়ী চলছে। তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা যে নিয়ম স্থির করে রেখেছেন তার বাইরে তারা যেতে পারে না। মহাবিশ্বের কোথাও তার সে নিয়মের কোন ব্যত্যয় নেই এবং তা হওয়া সম্ভব নয়। ইরশাদ হয়েছে,
ﭽ ﯴ ﯵ ﯶ ﯷ ﯸ ﯹ ﯺ ﯻ ﯼ ﯽ ﯾ ﭼ
সূর্য পারে না চাঁদকে গিয়ে ধরতে আর রাতও পারে না দিনকে অতিক্রম করতে। প্রত্যেকেই আপন-আপন কক্ষপথে সাঁতার কাটে। [ইয়াসীন:৪০]
ﭽ ﭯ ﭰ ﭱ ﭲ ﭳ ﭴ ﭵ ﭶ ﭷ ﭸ ﭹ ﭺ ﭼ
আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলিও সকাল ও সন্ধ্যায়। [সূরা রা‘আদ-১৫] অর্থাৎ বস্তু ও আয়তন সব কিছুই আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানের সামনে আনত। সে বিধান লঙ্ঘনের ক্ষমতা নেই কারও। এমনকি ছায়ার হ্রাস-বৃদ্ধিও তার ইচ্ছা অনুসারেই হয়ে থাকে।
মানুষের ব্যাপারটা দু’রকম। মানুষের কিছু আছে প্রাকৃতিক বিষয়, যাতে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন ভূমিকা নেই। যেমন কে কখন জন্ম নেবে, গায়ের রং ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেমন হবে। বুদ্ধি-বিবেচনা ও অভ্যন্তরীণ গুণাবলী কী রকম হবে। আয়ু, জীবিকা ইত্যাদির পরিমাণ কী হবে ইত্যাদি। মানুষের এ জাতীয় বিষয় তার ইচ্ছার কোনও রকম সংশ্লিষ্ট ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা অনুসারে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে মানুষ বিলকুল নিরুপায় এবং সরাসরি নিয়তিচালিত।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে মানুষের কার্যাবলী, যা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মানুষ জড় পদার্থের মত সম্পূর্ণ বাধ্য ও ইচ্ছারহিতও নয় এবং নিরঙ্কুশ স্বাধীনও নয়।
জড় পদার্থের মত যে নয়; বরং কিছু না কিছু কর্ম স্বাধীনতা তার আছে, এটা বোঝার জন্য বিশেষ বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার পড়ে না। কোন মানুষই নিজেকে জড় পদার্থের মত মনে করে না। কেউ নিজেকে অন্যের হাতের পুতুল বলে ভাবতে পারে না; বরং এরূপ ভাবকে প্রত্যেকেই নিজের পক্ষে অবমাননাকর ও গালিস্বরূপ মনে করে। তা কেন মনে করে? এজন্যই তো যে, আপন চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মে সে নিজেকে স্বাধীন সত্তা বলেই বিশ্বাস করে। সুতরাং মানুষের কর্ম-স্বাধীনতার বিষয়টা একটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয়, যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে সে স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়। এক পর্যায়ে অদৃষ্টের কাছে হার মানতেই হয় এবং এটাও এক অনস্বীকার্য সত্য। প্রত্যেকেরই জীবনে এর বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে। মনে কতকিছু করার সাধ জাগে। তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টাও চালানো হয়। এক পর্যায়ে দেখা যায়, চেষ্টাই সার। সাধ আর পূরণ হয় না। আবার অনেক কিছুকেই অনাকাক্সিক্ষত ভেবে এড়ানোর চেষ্টা করা হয়। সেজন্য সব রকম তদবির করা হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে সব তদবির ব্যর্থ হয় এবং তকদীরের কাছেই হার মানতে হয়। সুতরাং মানুষ নিরঙ্কুশ স্বাধীনও নয়।
বস্তুত নিরঙ্কুশ স্বাধীন হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। কেননা তার অর্থ দাঁড়ায় তার উপর আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন সৃষ্টির উপর স্রষ্টার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকা সম্ভব কি? আল্লাহ তায়ালা সর্বশক্তিমান। তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার কোন সীমা পরিসীমা নেই। তার জ্ঞান যেমন সর্বব্যাপী, কুদরতও তেমনি সর্বব্যাপী। তার জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার সাধ্য নেই কারও। জগত-সংসারের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ সম্পর্কে এটাই তাওহীদি আকীদার শিক্ষা। সুতরাং আপন কর্মে এক পর্যায়ে স্বাধীনতা থাকার পরও মানুষ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা এখতিয়ারের অধীন। অর্থাৎ স্বাধীনতা ও অপারগতা এ দুয়ের মাঝখানে তার অবস্থান। বিষয়টাকে হয়তো আলী রা. এভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, তুমি চাইলে এক পা তুলে অন্য পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পার, কিন্তু দুুটো পা-ই তুলে রেখে যদি দাঁড়াতে চাও, তা পারবে না কিছুতেই। ব্যস, এই হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা ও বাধ্যবাধকতা। সে পূর্ণ স্বাধীনও নয় এবং পূর্ণ নিরুপায়ও নয়।
সে সব বিষয় উপায়-উপকরণের সাথে যুক্ত, তাতে নজর দিলে এ কথা আরও বেশি পরিস্ফুট হয়। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায়, চাষাবাদ করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, ওষুধ খাওয়া ইত্যাদি কাজসমূহ মানুষের ইচ্ছাধীন।
এগুলো উপায়-উপকরণ। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ফসল জন্মানো, জীবিকা অর্জন করা ও আরোগ্যলাভ করা। এগুলো সেই উপায়-উপকরণের ফল। সেই উপায় অবলম্বনে মানুষ স্বাধীন হলেও এই ফল লাভে সে আদৌ স্বাধীন নয়। এতে তার কোন এখতিয়ারই নেই। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাধীন। তিনি চাইলে এ ফল দিতেও পারেন, চাইলে নাও দিতে পারেন। যদিও ইহজগতে তাঁর রীতি হল উপায় অবলম্বন করলে ফল দিয়ে দেওয়া। তার ঘোষণা রয়েছে।
ﭽ ﰂ ﰃ ﰄ ﰅ ﰆ ﰇ ﰈ ﰉ ﰊ ﰋ ﰌ ﭼ
মানুষ তাই পায় যা সে করে এবং তার কর্ম অচিরেই দেখানো হবে। [সূরা নাজম: ৩৯,৪০]
এ কারণেই উপায় অবলম্বন জরুরী। বেকার বসে থাকা ইসলামের শিক্ষা নয়। যেহেতু উপায় অবলম্বনের ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। যে বিষয়ে নিজ ক্ষমতা আছে। বৈধ পন্থায় তাতে লিপ্ত থাকাই সে ক্ষমতার যথার্থ মূল্যায়ন এবং এটাই কাম্য। তবে ফলাফলের বিষয়টা যেহেতু আল্লাহর হাতে তাই তাঁর হাতেই তা ছেড়ে রাখা চাই। তা নিয়ে মাথা ঘামানো বোকামি। আল্লাহ তায়ালা চাইলেই তা অর্জিত হবে। মাথা ঘামিয়ে কিছু লাভ হবে না। তাতে অশান্তি অস্থিরতাই বাড়বে। সারকথা, চেষ্টা-চরিত্রে বান্দা স্বাধীন কিন্তু ফলপ্রাপ্তিতে সে স্বাধীন নয়, তা সম্পূর্ণ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাধীন।
দেখা যাচ্ছে আপন কাজে মানুষের কিছু না কিছু স্বাধীনতা আছে। এই স্বাধীনতার কারণেই তার উপর বিধি-বিধান আরোপ করা হয়েছে। সে চাইলে নিজ ইচ্ছা প্রয়োগের সাথে তা পালনও করতে পারে এবং চাইলে পালন নাও করতে পারে। ইচ্ছার এ স্বাধীনতার কারণেই সে পুরস্কার ও শাস্তির উপযুক্ত হবে। এই হচ্ছে তাকদীর ও নিয়তি সম্পর্কে মোটামুটি কথা। এর বেশি গভীরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মূলত এ এক অন্তহীন রহস্য। আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান ও অপার কুদরতের সাথে এর সম্পর্ক। সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধির মানুষের পক্ষে এর কুল-কিনারা পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বেশি গভীরে না গিয়ে এই সরল ও সাদামাঠা ধারণার উপরই ক্ষান্ত থাকা উচিত। কুরআন মাজীদে তাকদীর সম্পর্কে এরূপ সহজ-সরল ধারণাই আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা যাচ্ছে-
ﭽ ﰌ ﰍ ﰎ ﰏ ﰐ ﭼ
১. আমি প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাণে। [কামার: ৪৯]
ﭽ ﯔ ﯕ ﯖ ﯗ ﯘ ﯙ ﭼ
২. আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটা পরিমাণ স্থির করেছেন। [তালাক: ৩]
ﭽ ﯦ ﯧ ﯨ ﯩ ﯪ ﯫ ﯬ ﯭ ﯮ ﯯ ﯰ ﭼ
৩. সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করেছেন যথাযথ অনুপাতে। [ফুরকান: ২]
ﭽ ﰅ ﰆ ﰇ ﰈ ﰉ ﰊ ﰋ ﰌﰍ ﰎ ﰏ ﰐ ﰑ ﰒ ﰓ ﰔ ﰕ ﰖ ﰗ ﰘﭼ
৪. ‘আল্লাহর অজ্ঞাতসারে কোন নারী গর্ভধারণ করে না এবং প্রসবও করে না। কোন দীর্ঘায়ু ব্যক্তিকে যে আয়ু দেওয়া হয় এবং তার আয়ুতে যা হ্রাস করা হয় তার সবই এক কিতাবে (লাওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ আছে। [ফাতির: ১১]
ﭽ ﭞ ﭟ ﭠ ﭡ ﭢ ﭣ ﭤ ﭼ
৫. কোন মসিবতই আল্লাহর হুকুম ছাড়া আসে না [তাগাবুন: ১১]
ﭽ ﮯ ﮰ ﮱ ﯓ ﯔ ﯕ ﯖ ﯗ ﯘ ﯙ ﯚ ﯛ ﯜ ﯝ ﯞ ﯟﯠ ﯡ ﯢ ﯣ ﯤ ﯥ ﯦ ﯧ ﯨ ﯩ ﯪ ﯫ ﯬ ﯭ ﯮ ﯯﯰ ﯱ ﯲ ﯳ ﯴ ﯵ ﯶ ﭼ
৬. পৃথিবীতে অথবা তোমাদের প্রাণের উপর যে মসিবত দেখা দেয় তার মধ্যে এমন কোনোটি নেই, যা সেই সময় থেকে এক কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই যখন আমি সেই প্রাণসমূহ সৃষ্টিও করিনি। নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ। তা এই জন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তার জন্য যাতে দুঃখিত না হও এবং যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন তার জন্য উল্লাসিত না হও। আল্লাহ এমন কোন ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। যে দর্প দেখায় ও বড়ত্ব প্রকাশ করে। [হাদীদ-২২-২৩]
তাকদীর সংক্রান্ত আয়াতসমূহ দ্বারা যেমন এ বিশ্বাসের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়, তেমনি জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ে এ বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে- অদৃষ্ট বিশ্বাস দ্বারা তাওহীদের বিশ্বাস পরিপূর্ণতা লাভ করে। যে ব্যক্তি তাকদীরকে বিশ্বাস করে না, সে আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান ও এখতিয়ারকে সংকুচিত করে ফেলে। তার বিশ্বাস মতে জগতে এমন বহু কিছু ঘটে, যে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার কোন পূর্ব সিদ্ধান্ত নেই। তাঁর জ্ঞান ও ইচ্ছার বাইরে স¤পূর্ণ নতুনভাবে তা ঘটে। ভাল-মন্দ কার্যকলাপেও মানুষ এমনই স্বাধীন যে, তাতে আল্লাহ তায়ালার কোন ইচ্ছা কার্যকর নয়। মানুষের ইচ্ছাই তাতে চূড়ান্ত। এভাবে সে আল্লাহর পাশাপাশি এক নিরঙ্কুশ ইচ্ছাময়কে দাঁড় করায়, যা তাওহীদের পরিপন্থী এক শিরকী ধারণা। এজন্যই বলা হয়, যারা তাকদীর বিশ্বাস করে না, তারা এ উম্মতের মাজুসী (যারা দুই ঈশ্বরে বিশ্বাসী)।
সুতরাং ব্যক্তির তাওহীদী বিশ্বাস তখনই পূর্ণতা লাভ করবে যখন সে বিশ্বাস করবে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে যা কিছু ঘটছে ও ঘটবে সবই আল্লাহ তায়ালার পুর্বসিদ্ধান্তের অধীন। তাঁর ইচ্ছা ও মহাপরিকল্পনার বাইরে মহাজগতের কোন কিছুই ঘটে না-
ﭽ ﯺ ﯻ ﯼ ﯽ ﯾ ﯿ ﰀ ﰁ ﰂ ﰃ ﰄ ﰅ ﰆ ﰇ ﰈ ﰉ ﰊ ﰋ ﰌ ﭼ
‘তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মাটির অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণা অঙ্কুরিত হয় না অথবা তাজা ও শুকনা এমন কোন বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাব (লাওহে মাহফুজে) লিপিবদ্ধ নেই। [আন‘আম-৬০]
মানবমনে যখন এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, নিয়তিতে যা নির্ধারিত আছে কেবল তাই ঘটে ও তাই ঘটবে তার বাইরে কিছু ঘটবে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ তায়ালার প্রতি এক অটুট আস্থা জন্ম নেয় এবং কঠিন থেকে কঠিনতর কাজের হিম্মত সৃষ্টি হয়ে যায়। তখন দুশমন যত শক্তিশালী হোক তাকে ভয় পায় না। ঝুকি যত প্রচ-ই হোক পরওয়া করে না। এবং হুমকি যত মারাত্মকই হোক গ্রাহ্য করে না। তা করবেই বা কেন যখন সে জানে,
ﭽ ﮒ ﮓ ﮔ ﮕ ﮖ ﮗ ﮘ ﮙ ﮚ ﮛ ﭼ
আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারও মৃত্যু হতে পারে না। যেহেতু তার মেয়াদ সুনির্দিষ্ট [আলে ইমরান-১৪৫]
ﭽ ﮇ ﮈ ﮉ ﮊ ﮋ ﮌ ﮍ ﭼ
আমাদের জন্য আল্লাহ যা নির্দিষ্ট করেছেন তা ছাড়া আমাদের অন্যকিছু হবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক [তাওবা: ৫১]
এ বিশ্বাসে বলিয়ানের পক্ষেই সম্ভব দজলা নদীর উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেওয়া, তরবারির দোচালা পথে বেপরোয়া এগিয়ে চলা এবং সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্য-ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা। সুতরাং ভাগ্যবিশ্বাসের সাথে কর্মবিমুখতার কোন সম্পর্ক নেই। বরং এ বিশ্বাস দৃঢ় মনোবল ও ন্যায় নিষ্ঠতার সাথে কর্মমুখর হওয়ার প্রেরণা যোগায়। তাই তো ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এ বিশ্বাস যাদের অন্তরে সর্বাপেক্ষা বেশি দৃঢ় ছিল সেই সাহাবীগণ মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ বেশি কর্মতৎপর ছিলেন। ইবাদত বন্দেগীতে যেমন তারা ছিলেন অসাধারণ নিষ্ঠাবান, তেমনি জাতীয় উৎকর্ষসাধন ও ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টায়ও তারা ছিলেন সর্বকালের সেরা আদর্শ। এ রকম অদম্য সাহসী, দুর্নিবার দিগি¦জয়ী, কর্তব্যকর্মে অটুট-অবিচল, পাহাড়সম ধৈর্যের অধিকারী, অথচ নিরহংকার ও বিনয়-বিনম্র একটি কর্মবীর সম্প্রদায়ের নজীর কে কোথায় খুজে পাবে? সন্দেহ নেই তাদের এ অসাধারণত্ব তাকদীর বিশ্বাসের সুফল।
এ বিশ্বাস যার অটুট সে যে কোন প্রলোভনকে সহজেই অগ্রাহ্য করতে পারে। যে চিন্তা করে আমার ভাগ্য তো নির্ধারিত হয়েই আছে। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা রয়েছে-
ﭽ ﯞ ﯟ ﯠ ﯡ ﯢ ﯣ ﯤ ﭼ
পার্থিব জীবনে তাদের জীবিকা আমিই বণ্টন করেছি। [যুখরুফ: ৩২]
ﭽ ﮨ ﮩ ﮪ ﭼ
এবং আসমানেই (নির্ধারিত হয়ে আছে) তোমাদের রিযক। [যারিয়াত: ২২]
সেই নির্ধারিত হিস্যার অতিরিক্ত কেউ পেতে পারে না। সুতরাং অহেতুক ন্যায়-নীতি বিসর্জন দেওয়া কেন? এভাবে সে লোভ, লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মন্দ চরিত্র থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
অদৃষ্ট বিশ্বাস মানবমনে কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত করে ও তাকে অহংকার অহমিকা থেকে রক্ষা করে। কেননা সে যখন জানে তার যা কিছু প্রাপ্তি সবই পূর্ব নির্ধারিত, তখন কোন অর্জন ও সফলতাকেই নিজ বুদ্ধি-কৌশল ও চেষ্টা শ্রমের ফসল ভেবে গর্ব করতে পারে না। বরং সে চিন্তা করে এটা কেবলই আল্লাহ তায়ালার দান। তিনি চাইলে আমার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থও করে দিতে পারতেন। যেমন অনেকেরই ব্যর্থ হয়। তা না করে যখন আমাকে সফলতা দান করেছেন তখন তাঁর শুকর গোযারী করা আমার অবশ্যকর্তব্য।
আবার কারও চেষ্টা-শ্রম বৃথা গেলে ভাগ্যবিশ্বাসই পারে তাকে হতাশা থেকে রক্ষা করতে। কারণ সফলতা যখন চেষ্টার অনিবার্য ফল নয়; বরং আল্লাহর দান যে ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত স্থির হয়ে আছে। তখন বিফলতার ক্ষেত্রে এই বলে নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার সুযোগ হয় যে, এটা আমার ভাগ্যেই ছিল না কিংবা এই মুহূর্তে পাওয়ার ছিল না। কাজেই যতই চেষ্টা করি না কেন আমি ভাগ্যকে তো খ-াতে পারব না।
আমার কর্তব্য ভাগ্যকে বরণ করে নেওয়া ও আল্লাহ তায়ালার ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা। একে রিযা বিল কাযা বলে। এটা ফরজ। এরূপ যে করবে তার জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক বড় সুসংবাদ আছে। ইরশাদ হয়েছে-
ﭽ ﭫ ﭬ ﭭ ﭮ ﭯ ﭰ ﭱ ﭲ ﭳ ﭴ ﭵ ﭶ ﭷ ﭼ
সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদেরকে, যারা তাদের উপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে আমরা তারই কাছে ফিরে যাব। [বাকারা: ১৫৬]
এ সন্তুষ্টি যেমন উপস্থিত যে কোনও বিপদাপদে জরুরী, তেমনি জরুরী প্রাপ্ত জীবিকা স্বাস্থ্য সম্মান স্বামী স্ত্রী সন্তান তথা আল্লাহ প্রদত্ত জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুতে।
অহমিকা ও হতাশানাশ এবং খুশীমনে পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়ার এই সুফল সম্পর্কেই ইরশাদ হয়েছে-
ﭽ ﯧ ﯨ ﯩ ﯪ ﯫ ﯬ ﯭ ﯮ ﯯ ﭼ
(তাকদীরের লিখন) এজন্য যে, তোমরা যা হারিয়েছ তার জন্য যাতে হতাশাবোধ না কর এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে উল্লাসিত না হও। [হাদীদ-২২]
অদৃষ্ট বিশ্বাস কেবল অহমিকা ও হতাশারোধকই নয়; সেই সাথে নবোদ্যমের উদ্বোধকও বটে। কেননা অদৃষ্টে কি আছে তা তো জানা নেই। এবারের চেষ্টা বিফলে গেছে বলে আগামীতেও সফলতা লাভ হবে না, এমন তো কোন কথা নেই। সুতরাং চেষ্টাতে ক্ষান্ত দেওয়া কোন বুদ্ধির কথা নয়। বুদ্ধির দাবি আল্লাহ তায়ালার ঘোষণায় আস্থা রাখা যে,
ﭽ ﰂ ﰃ ﰄ ﰅ ﰆ ﰇ ﭼ
মানুষ তাই পায় যা সে করে। [নাজম: ৩৯]
লেখক: শাইখুল হাদীস, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া তেজগাঁও ঢাকা।