এটা প্রকাশ্য ব্যাপার যে আমি আধুনিক শিক্ষা ব্যাবস্থার সমালোচনা করি। একশ বছর আগে থেকে একটা গবেষণা শুরু করা হয়েছিল, যার ফলাফল হিসেবে দাঁড়িয়েছে যে, বর্তমান আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে অন্ধকারে ফেলে দিয়ে নিজ ব্যবস্থাপনাকে ব্যর্থ হিসেবে তুলে ধরেছে। . যাইহোক, আগেরকার শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল না। মুসলিম স্বর্ণযুগে, শিক্ষা কার্যক্রম চলতো মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঘরে শিক্ষক রেখে পড়াশোনা করার মাধ্যমে, যা আমাদেরকে দুর্দান্ত কিছু মানুষ উপহার দিয়েছিল। . নোটঃ মাদ্রাসা হলো আগেরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে গণিত থেকে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও অন্যান্য বিষয়াদি পড়ানো হত। এই লেখায় মাদ্রাসা বলতে বর্তমান সেক্যুলার ভার্সন মাদ্রাসার কথা বলা হয়নি যা শুধুমাত্র ধর্মীয় পড়াশোনা নিয়ে চলছে। . সামনে যাওয়ার পূর্বে আমরা আগেরকার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করবো, যার কারণগুলো তাদেরকে এত দূর নিয়ে গিয়েছিল। তৎকালীন মুসলিম সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে উন্নতের কারণ হিসেবে ৫টি কারণ আমরা নিতে পারি যা আমাদের সময়ে প্রয়োগ করলে পুরো দুনিয়াই বদলে যাবে। 1. তা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিত। মুসলিম স্বর্ণযুগে বর্তমানের মতন সকল বিষয় পড়ার ব্যবস্থা ছিল না। ৭ বছর বয়স থেকেই শিক্ষার্থী কোন দিকে বেশি মনোযোগী তা দেখা হত এবং তাকে সেদিকেই পড়াশোনার জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হত। যার কারণে একজন শিক্ষার্থীর পিছনে অহেতুক সময় নষ্ট করা হত না। আর শিক্ষার্থীর জীবনে অহেতুক দিকে মনোযোগ না দেয়ায় মূল্যবান সময়ও বেঁচে যেত। চিন্তা করুন একবার, যার ভাষার দিকে মনোযোগ, সে কেনো উচ্চতর গণিত শিখতে যাবে? কিংবা যার গণিতের দিকে মনোযোগ, সে কেনো ব্যয়াকরণ শিখতে যাবে? যার ইতিহাস নিয়ে পড়ার ইচ্ছা, সে কেনো বিজ্ঞানের একার আকার পড়ে পরীক্ষা দিতে যাবে? কিংবা যার আর্কিটেকচারের প্রতি মনোযোগ, সে কেনো বিভিন্ন বিজ্ঞানীর নাম কিংবা ইতিহাসে হয়ে যাওয়া যুদ্ধের তারিখ মুখস্থ করবে? যখন একজন শিক্ষার্থী যত তাড়াতাড়ি তার নিজস্ব ফিল্ড চিনবে সে তত তাড়াতাড়ি সেই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিবে। এর ধাপই আগেরকার জামানার শিক্ষার দ্বিতীয় ধাপে নিয়ে যায়। 2. কম বয়সে স্নাতকোত্তর শেষ করা। আগেরকার সময়ে বর্তমানের মতন ১৩ বছর পড়তে পড়তে সময় নষ্ট না করে, তারপর কে কোথায় এক্সপার্ট এসব না খুঁজে, ততকালীন শিক্ষার্থীরা সহজেই তাদের পড়াশোনা শেষ করে ফেলতেন। যার কারণে মুসলিম স্বর্ণযুগে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী ও ডাক্তার কম বয়স থেকেই তাদের প্রফেশনাল জীবন শুরু করে দিয়েছিলেন। ইবনে বাতুতা ২১ বছর বয়সে পড়াশোনা শেষ করে ক্বাদির (বিচারক) আসনে বসেন। ১৮ বছর বয়স থেকেই ইবনে সিনা রুগী দেখা শুরু করেন। বলাবাহুল্য, ইবনে খালদুন ত ১৭ বছর বয়সে ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে পড়েন! সুবহানআল্লাহ! এসব আমাদেরকে যে যেদিকে বেশি মনোযোগী তাকে সেদিকে পরিচালনা করার ব্যাপারেই বুঝায়। এই সকল ব্যক্তিরা নিজ নিজ ফিল্ডে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে রাজত্ব করে গিয়ে একে একে সমাজকে অনেক উপহার দিয়েছেন।। চিন্তা করুন, বর্তমানে যদি এ রকম ছোট থেকে একজন শিক্ষার্থীকে গাইড করা হত, তারপর কম বয়সে গ্রেজুয়েট হয়ে কাজকর্মে লেগে যেত। যার ফলে আবিষ্কার হত নতুন নতুন জিনিস এবং হয়ত ছোট থেকেই নিজের ল্যাগাসী তৈরি করতো। কিন্তু বর্তমান সিস্টেমের ফাঁদে পড়ে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা। ৩)তখনকার সময় অনেকগুলো শিক্ষাব্যবস্থা ছিল। শিক্ষার একক ব্যবস্থা সকলের উপকারে আসে না। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন উপায়ের মাধ্যমে শিক্ষার্জন করে এবং তাই শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে অনেগুলো সিস্টেম থাকা উচিৎ। যাতে শিক্ষার্থীরা এমনভাবে অধ্যয়ন করতে বেছে নিতে পারে যা তাদের নিজেদের শিক্ষার্জনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। মুসলিম স্বর্ণযুগে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী মাদ্রাসা সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষার্জন করেছেন, আবার অনেকে বাড়িতে বই পড়ে পড়ালেখা করে শিক্ষার্জন করেছেন। কেউ কেউ ল্যাবে এক্সপেরিমেন্টে ব্যস্ত ছিলেন ত কেউ শিক্ষকের পায়ের কাছে বসে শিক্ষা নিতে। কেউ কেউ সবগুলো একত্রেও চালিয়ে গিয়েছেন শিক্ষার্জনের জন্য। তাই শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর শিক্ষার্জনে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। আমাদের এই চিন্তা করা বন্ধ করতে হবে যে, এক সিস্টেম সবার শিক্ষার্জনের জন্য উপযুক্ত। শিক্ষাক্রমে আমাদের আসলে আরও বৈচিত্র্য দরকার। যদি কেউ উদাসীন হয়, তবে তাকে ঘরে থাকতে দিয়ে এবং যতটা সম্ভব বই গ্রাস করিয়ে শিক্ষাদান দেয়া উচিৎ। যদি কেউ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আরও ভাল শিখতে চায় তাহলে তাকে স্কুলে না দিয়ে ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়া উচিৎ কারোও আন্ডারে যাতে সে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারে। (যা আইনস্টাইনের অভিভাবক করেছিলেন) বিশ্বের আরও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন। যাতে শিক্ষার্থীরা বক্তৃতা দিতে যেয়ে আটকে না যায় এবং চঞ্চল শিক্ষার্থীরা যাতে ক্লাসে চুপচাপ বসে থাকতে না পারে। আধুনিক বিশ্বে এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োগের জন্য আমাদের উপায় খুঁজে বের করতে হব। এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে আমরা তা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি মানুষের কাছে। ৪)তারা সেক্যুলার এবং ইসলাম শিক্ষার মধ্যে বিভাজন করেননি। বর্তমান বিশ্বে স্কুল ও মাদ্রাসার বিচ্ছিন্নতা ঔপনিবেশিকতার ফল যা মুসলমানদের মনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। মুসলমানদের পুরো একটা প্রজন্মকে এই ভেবে উত্থাপিত করা হয়েছে যে গণিত, বিজ্ঞান এবং ভাষার সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং বুঝানো হয়েছে যে, ইসলাম হলো এমন একটি বিষয় যা আপনি দুপুর বেলা সময় করে পড়বেন। তবে আপনার অগ্রাধিকার হিসেনে থাকবে শিক্ষাব্যবস্থায় থাকা সকল 'সেক্যুলার বিষয়’। ইসলাম আমাদেরকে সক্রিয়ভাবে সমস্ত উপকারী জ্ঞান আহরণ করতে শেখায়। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বাসের জ্ঞান, ইসলামিক আইন, ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, ব্যবসা, ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং যা আমাদের উপকার আসে এমন সবকিছু। মুসলিম স্বর্ণযুগে এটাই রীতি ছিল। আল-খাওয়ারিজমি ইসলামী উত্তরাধিকার আইনের সমস্যা সমাধানের জন্য বীজগণিত আবিষ্কার করেছিলেন। ইবনে সিনা ঔষধ নিয়ে কাজ করেছিলেন কারণ নবী (সা) আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, প্রতিটি অসুস্থতার একটি নিরাময় রয়েছে। ইবনে খালদুন ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন কারণ কুরআন আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে বলেছে। এই শিক্ষাব্যবস্থায় একটা আরেকটার সাথে জড়িত ছিল. আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরে আসতে হবে যা ধর্মীয় এবং অধর্মীয় বিষয়গুলির মধ্যে বিভাজন করে না। মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো 'উপকারী জ্ঞান।' ৫)আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করাতো। মুসলিম স্বর্ণযুগে শিক্ষার্জন মূলত সম্পদ, খ্যাতি ও মর্যাদা অর্জনের জন্য ছিল না। (যদিও এই ধরনের ব্যক্তিদের অস্তিত্ব ছিল) মাদ্রাসা ব্যবস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল এমন নাগরিক তৈরি করা যারা কাজের দ্বারা আল্লাহর ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সৃষ্টির যত্ন নেবে। শিক্ষা ছিল সম্প্রদায়ের স্বার্থে, নিজের স্বার্থে নয়। এটা আল্লাহর জন্য ছিল, নিজের খায়েসে জন্য ছিল ন। এবং তা বিশ্বকে বসবাসযোগ্য করে তোলার জন্য ছিল, শুধুমাত্র নিজের পকেট ভরার জন্য নয়। এ কারণেই মুসলিম স্বর্ণযুগে, আমরা বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা (এমনকি পশুদের জন্য), বিনামূল্যে শিক্ষা, দাতব্য কাজের সমগ্র ব্যবস্থা এবং মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সুখের অস্তিত্ব খুঁজে পাই। যে শিক্ষাব্যবস্থা স্বার্থপর বস্তুবাদী সাফল্যের উপর ফোকাস করে তা অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধুমাত্র স্বার্থপর ব্যক্তিই তৈরি করে। এর ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়, আর তা হলো "আল্লাহর সৃষ্টির যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহকে খুশি করা।" . || যেসব কারণে মুসলিম সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো সবচেয়ে উন্নত || মূলঃ ইসমাইল কামদার। অনুবাদঃ ওয়াহিদুল হাদী।

সম্পর্কিত পোস্ট
আমার নানা বা দাদার আপন ভাই তথা চাচাত নানা-দাদার সাথে...
08 Sep, 2025
অনুচ্ছেদ : রাসূলুল্লাহ (সা) এর ওফাতের তারীখ ও সময় ওফাত কালে উনার বয়স, তার গোসল ও কাফন দাফনের বিবরণ তাঁর সমাধির স্থান নির্ধারণ
08 Sep, 2025
হায়াতুস সাহাবা pdf
08 Sep, 2025
অভিধান (বাংলা, আরবী, উর্দূ ও ইংরেজী) Pdf
08 Sep, 2025
ছবি অঙ্কনকারী বা চিত্র শিল্পীদের পরিণাম
08 Sep, 2025

পর্নের ব্রেইন ইফেক্ট পর্ব-১
08 Sep, 2025

অন্তর মরে যাওয়ার দশ কারণ
08 Sep, 2025
পর্নের ব্রেইন ইফেক্ট পর্ব-২
08 Sep, 2025