ব্লগ পোস্ট

সমাজ নয়, সংস্কার শুরু করুন নিজেকে দিয়ে

সমাজ নয়, সংস্কার শুরু করুন নিজেকে দিয়ে

শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকি উসমানি  অনুবাদ : জহির উদ্দিন বাবর ‘সময়টা অনেক খারাপ’, ‘আমানতদারি মানুষের অন্তর থেকে উঠে গেছে’, ‘ঘুষের বাজার গরম’, ‘অফিস আদালতে পয়সা অথবা সুপারিশ ছাড়া কোনো কাজ হয় না’, ‘সবাই লুটেপুটে খাওয়ার ধান্দায় লিপ্ত’, ‘ভদ্রতা ও উন্নত চরিত্র বিদায় নিয়েছে’, ‘চারদিকে শুধু দ্বীনহীনতার সয়লাব’, ‘লোকেরা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি গাফেল হয়ে বসে আছে’-এ জাতীয় কথাবার্তা প্রতিদিন আমাদের কোনো না কোনোভাবে শুনতে হয়। আমাদের এমন কোনো মজলিস নেই যেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা হয় না। এসব অভিযোগ মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবেই জীবনের যে কোনো দিকে দৃষ্টি দিন শুধু অধঃপতনই চোখে ভাসবে। সমাজের অবক্ষয় আমাদেরকে চারদিকে ছেয়ে ফেলছে। অন্যদিকে সমাজ সংশোধনের চেষ্টাগুলোর দিকে তাকালে সেখানেও কম প্রচেষ্টা নজরে আসবে না। কত সংস্থা, সংগঠন, দল সমাজ সংশোধনের কাজে নিয়োজিত আছে! প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিছু না কিছু করছে। হয়ত দেশের উল্লেখযোগ্য কোনো অংশ এ ধরনের প্রচেষ্টাশূন্য নয়। এ ধরনের কিছু প্রচেষ্টার ছাপ আমরা দেখতেও পাই। তবে সমাজের সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে এ ধরনের প্রচেষ্টার বিষয়টি অনুভবই হবে না। চারদিকে শুধুই পতনের সুর শোনা যাবে, আশার কোনো ছিটেফোঁটাও দেখা যাবে না। এ অবস্থার জন্য তো অনেক বিষয় দায়ী। সবগুলো তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। তবে এখানে শুধু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করবো যেদিকে সাধারণত আমাদের চোখই পড়ে না। সেটা হলো আমাদের সামষ্টিক মানসিকতা। আমরা সব সময় ব্যস্ত থাকি অন্যের সমালোচনায়, অপরের দোষ খোঁজার পেছনে। কারও দোষত্রুটি নিয়ে আলোচনা করতে আমরা যতটা মজা অনুভব করি সেটা সংশোধনমূলক কোনো কাজের ক্ষেত্রে করি না। অথচ অপরের ত্রুটি চর্চা করেই আমাদের বেলাগুলো কাটছে। এসব ত্রুটি সংশোধনের কোনো প্রচেষ্টা নিয়েও আমরা ভাবি না। অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনো আন্দোলন ও কাজ শুরু হলে আমাদের চেষ্টা থাকে এটা অন্য কারও দ্বারা শুরু হোক। ‘আমি ছাড়া দুনিয়ার সব লোক খারাপ’ এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। তাদের সংশোধন করার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তেছে। এটা ভাবার সময় এমন ভাবনা খুব কম লোকের ভেতরেই আসে যে, কিছু দোষত্রুটি তো আমার মধ্যেও আছে। আমার তো সবার আগে এসবের সংশোধন করা দরকার। সুতরাং সংশোধনের যে প্রচেষ্টায় শুধু অন্যকে লক্ষ্য বানানো হয় এবং নিজের বিষয়টি একদম এড়িয়ে যাওয়া হয় সেটা ফলপ্রসূ হবে না এটাই স্বাভাবিক। সামাজিক অবস্থা ও লোকদের কর্মপদ্ধতিতে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ক্ষতিকর দিকটি হলো অনেক সময় নিজের ভুলকে জায়েজ করার জন্য সমাজে ছড়িয়ে পড়া খারাপ দিকগুলোর বৈধতা দেয়া হয়। এজন্য প্রায়ই এমনটা শোনা যায় যে, ‘এই কাজ তো ঠিক না, তবে যুগের অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে করতে হয়।’ এর ফল হলো আমরা সময়ের খারাপ দিকগুলোর আলোচনা এমনভাবে করি যাতে আমরা নিজেরা নিরাপদ ও নিষ্পাপ থাকি। অথচ সমাজজীবনে আমরা এসব কাজ দিব্যি করে যাচ্ছি। যদিও এসবের মন্দের দিকগুলো বর্ণনা করে আমরা মুখে ফেনা তুলে ফেলছি। মনে করুন, আপনার সামনে আগুন ধরেছে। আগুনের লেলিহান শিখা আস্তে আস্তে বাড়ছে। আপনি এখান থেকে না সরলে আপনাকে আগুন গ্রাস করে নেবে। এখন কি আপনি এখানে বসে বসে আফসোস করবেন? হাত-পা নাড়াবেন না? একজন নির্বোধও তখন দ্রুত ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেবে। নিজেকে বাঁচানোর যা যা পদ্ধতি আছে তা অবলম্বন করবে। কোনোভাবেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে অন্তত নিজেকে রক্ষা করবে। কেউ আগুন নেভানোর কোনো প্রচেষ্টা না করে, আগুনের কিচ্ছা বলে বেড়ালে আর নিজেও সেখান থেকে না সরলে সেটা চূড়ান্ত পর্যায়ের বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ আমরা সমাজের আগুনের (ক্ষতিকর দিকগুলো) কথা দিনরাত বলে যাচ্ছি, কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো কাজ করছি ওই নির্বোধের মতো যে আগুনের কিনারে দাঁড়িয়েও আগুন নেভায় না এবং আগুন থেকে নিজেও বাঁচার কোনো প্রচেষ্টা চালায় না। আমরা রাত-দিন ঘুষখোরদের নিন্দা করে যাচ্ছি। অথচ সুযোগ পাইলে আমরা নিজেরাও ঘুষ নিই এবং অনেক সময় বাধ্য হয়ে দিই। মিথ্যা, খেয়ানত ও হারাম খাবারের নিন্দায় আমরা পঞ্চমুখ। অথচ আমরা নিজেরাও এ থেকে বিরত নই। কেউ এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুললে আমরা বলে বেড়াই, সারা দুনিয়া যেভাবে চলছে সেভাবেই আমাকেও চলতে হবে। এটা কি ওই লোকের মতো নয় যে আগুনের পাশে দিব্যি বসে আছে, আগুন গায়ে লেগে যাচ্ছে অথচ তার কোনো বোধ নেই! সমাজে যখন খারাপ কাজের ব্যাপক প্রচলন হবে তখন কী করতে হবে এর একটি নীতিমালা কুরআনে কারিমে ঘোষণা করা হয়েছে। কুরআনের ভাষ্য হলো: ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের চিন্তা কর। তোমরা যখন সৎপথে রয়েছ, তখন কেউ পথভ্রান্ত হলে তাতে তোমাদের ক্ষতি নেই। তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন, যা কিছু তোমরা করতে।’ [সুরা মায়েদা-১০৫] আয়াতটিতে এই বাস্তবতা বলে দেয়া হয়েছে যে, অন্যের খারাপ কাজ তোমার খারাপ কাজের কোনো দলিল নয়। তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে নিজের চরকায় তেল দাও। নিজে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাক। নিজের যাবতীয় সামর্থ্য নিজেকে সংশোধনের জন্য ব্যয় কর। যেসব খারাপি থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব তাৎক্ষণিকভাবে তা থেকে বেঁচে থাকো। যেসব মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা ও সাধনা প্রয়োজন এর জন্য সেই চেষ্টা ও সাধনা শুরু কর। তুমি অন্যকে দেখছো ঘুষ খাচ্ছে, অন্তত তুমি নিজেকে ঘুষ থেকে বাঁচিয়ে রাখো। অন্য কেউ খেয়ানত করছে এটা দেখতে পাচ্ছো, তুমি অন্তত নিজেকে সেই অপরাধ থেকে বিরত রাখো। অন্য কেউ অনর্গল মিথ্যা বলছে, তুমি সত্য বলার চেষ্টা কর। কেউ হারাম খাচ্ছে, তুমি শপথ কর হারাম কোনো খাবার আমার পেটে যাবে না। এটাই বলা হয়েছে এক হাদিসে, যার ভাষ্য হচ্ছে- ‘যখন তুমি দেখবে মানুষ প্রবৃত্তির পাগলা ঘোড়ার পেছনে দৌড়াচ্ছে, দুনিয়াকে সবকিছুতে প্রাধান্য দিচ্ছে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতে বিভোর, তখন তুমি বিশেষভাবে নিজের সংশোধনের কথা ভাবো। সাধারণ লোকের ভাবনা ছেড়ে দাও।’ [সুনানে তিরমিজি, কিতাবুত তাফসির, হাদিস নং ২৯৮৪; সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং ৩৭৭৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৪০০৪] এই হাদিসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব মুহূর্তে অন্যের দোষত্রুটি নিয়ে মেতে থাকা কোনো সমাধান নয়। বরং প্রত্যেকেই নিজের কথা চিন্তা করবে, নিজের সংশোধনের চেষ্টা চালাবে। অন্য হাদিসে রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ কথা বলে যে, লোকেরা নষ্ট হয়ে গেছে, তখন বাস্তবতা হলো প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে নষ্ট।’ [মুসলিম, কিতাবুল বিররি ওয়াসসিলাহ ওয়ালআদব, হাদিস নং ৪৭৫৫] অর্থাৎ যে প্রতি মুহূর্তে অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে বেড়ায়, নিজের ত্রুটির কোনো পরোয়া করে না সেই ব্যক্তিই বেশি ধ্বংসশীল। এর পরিবর্তে সেই ব্যক্তি নিজের সংশোধনের চেষ্টা অব্যাহত রাখলে অন্তত সমাজের একজন নষ্টামি থেকে রক্ষা পেত। আর নিয়ম হলো এক বাতি থেকে প্রজ্জ্বলিত হয় আরেক বাতি। একজন দ্বারা আরেকজন সংশোধন হয়। মূলত ব্যক্তির সমষ্টির নামই সমাজ। ব্যক্তি সংশোধনের ধারা অব্যাহত রাখলে একসময় সমাজও সংশোধন হয়ে যেতে বাধ্য। সমাজে যখন কেউ অন্যের দোষত্রুটিই শুধু দেখে এবং বলে বেড়ায় তখন এর দ্বারা হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এর দ্বারা নষ্টামির উৎপত্তি ঘটে। এই সমস্যার সমাধান হলো কুরআন-হাদিসের আলোকে যা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেকে নিজে আগে সংশোধনের চেষ্টা করবে। সমাজের যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর কোন কোনটি আমার মধ্যে আছে সেটা আগে বের করতে হবে। এরপর তা সংশোধনের চেষ্টা চালাতে হবে। বিষয়টি আমরা এভাবে কখনও ভাবিনি, এজন্য রাত-দিন শুধু অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতিই খুঁজে বেড়াই। অথচ একটু বিবেচকের চোখে তাকালে দেখতে পারবো, অতীতে এমন ব্যক্তি গত হয়েছেন যাদের একজনই অনেক কিছু করতে পেরেছেন। আমরা নিজের দিকে তাকালে দেখবো এখনই সংশোধন হওয়ার মতো অনেক ত্রুটি আমার মধ্যে রয়েছে। এমন অনেক ত্রুটি আছে যা সাধনার মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে। নিজে সংশোধনের চেষ্টা চালালে কেউ নেই সেই পথে বাধা সৃষ্টি করার মতো। সমাজের এই পতনোম্মুখ সময়েও আমরা সূক্ষ্মভাবে তাকালে এমন কিছু লোককে দেখতে পাবো যারা সামাজিক অনাচারের মধ্যে বসবাস করেও নিজেদেরকে তা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সমাজের ভয়াবহ অবস্থা দেখে তারা নিজেদের হাল ছেড়ে দেননি। আমাদের মধ্যে এই অনুভূতি তখনই জন্মাবে যখন মনেপ্রাণে সংশোধনের কথা ভাববো। আর নিজের সংশোধনের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। অন্তরে এই শক্তি সৃষ্টি হলেই আমরা বুঝতে পারবো সমাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার যে দুর্ভাবনা আমাদেরকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে সেটা সেটা কতটা অসাড়! রোগমুক্তির প্রথম ধাপ হলো রোগ অনুভূত হওয়া। ‘রোগটি আরোগ্য হওয়ার মতো’ এই অনুভূতি জাগ্রত হওয়া। আজ আমাদের উত্তরণের পথ হলো রোগ নির্ণয় করা এবং তা থেকে মুক্তি লাভের কথা চিন্তা করা। সূত্র : মাসিক আল-বালাগ, রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ সংখ্যা
সব ব্লগ পোস্ট নছীহত ক্যাটাগরি